প্রকাশ: সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:৫৬ পিএম আপডেট: ২৮.১২.২০২০ ১২:৫৮ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার কেওয়ার ইউনিয়নের সাতানিখিল খালে এক মর্মান্তিক গণহত্যা চালায়। এটি সাতানিখিল গণহত্যা নামে পরিচিত। তবে কেউ কেউ এই গণহত্যাকে কেওয়ার গণহত্যা বলেও অভিহিত করে থাকে। ১৪ মে সকালে হানাদার বাহিনী কেওয়ার চৌধুরী বাড়ি থেকে ২২ জনকে ধরে সাতানিখিলে নিয়ে এসে অধিকাংশকে নির্মমভাবে হত্যা করে। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক এবং সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। দু’জন ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান। বাকি তিনজনকে হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।
হানাদাররা সাতানিখিলে বেছে বেছে শুধু হিন্দুদের হত্যা করে। জাবেদ রহিম নামের এক পাকিস্তানি মেজর এই গণহত্যার নেতৃত্ব দেয়। মহাকালির কেদার রায় চৌধুরীর বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে মহাকালি গ্রাম। কেদার রায়ের বাবা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ছিলেন এই এলাকার সম্ভ্রান্ত জমিদার। আর কেদার রায় ছিলেন মুন্সিগঞ্জ কোর্টের স্বনামধন্য আইনজীবী। লোকজন তাকে জলধর মোক্তার হিসেবেই বেশি চিনতো। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে এপ্রিল মাসে নিরাপত্তার স্বার্থে মুন্সিগঞ্জ শহরের ২০-২৫টি পরিবার এই বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। কিন্তু হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় ১৩ মে বিকেলে বেশ কয়েকটি পরিবার আরও ভেতরের দিকের গ্রামে চলে যায়। মুন্সিগঞ্জ শহরের প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. সুরেন্দ্রচন্দ্র সাহা, অধ্যাপক সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য, সদর থানা পশুপালন কর্মকর্তা ডা. চিরঞ্জীবনাথ ভৌমিক, শ্রীনগর থানার পুলিশ কর্মকর্তা শচীন্দ্রনাথ মুখার্জি এবং পুরোহিত হরকুমার চক্রবর্তী পরিবার পরিজন নিয়ে চৌধুরী বাড়িতেই থেকে যান। সঙ্গে তাদের নিকট আত্মীয়রাও ছিলেন। এই পরিবারগুলো মুন্সিগঞ্জ শহরের বাগমামুদআলী এলাকার গোয়ালপাড়ায় বসবাস করতেন এবং একে অপরের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। হানাদার বাহিনী মুন্সিগঞ্জ শহরে ঢুকেই বুদ্ধিজীবী নিধনের পরিকল্পনা আঁটে।
এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা মহাকালি চৌধুরী বাড়িকে টার্গেট করে। স্থানীয় দালালরা হানাদারদের খবর দেয়, শহরের অধিকাংশ বুদ্ধিজীবী সপরিবারে এই বাড়িতে অবস্থান করছেন। তাদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য আগরতলা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ডা. সুরেন্দ্রচন্দ্র সাহার ছোট ছেলে সুভাষচন্দ্র সাহা যিনি মুন্সিগঞ্জ থানায় পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, তিনিও আছেন এই বাড়িতে। এছাড়া এই বাড়িতে অবস্থানকারী পুলিশ কর্মকর্তা শচীন্দ্রনাথ মুখার্জি গোপনে যুবকদের অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতেন। এসব খবরের ভিত্তিতে ১৩ মে গভীর রাত থেকে ৬০-৭০ জনের একদল হানাদার মহাকালি চৌধুরী বাড়ি ঘিরে রাখে। ভোরে তারা অপারেশন শুরু করে। দক্ষিণ কেওয়ারের আক্কাস আলী গাজি ও হরগঙ্গা কলেজের নৈশপ্রহরী আমান উল্লাহ হানাদারদের পথঘাট চিনিয়ে মহাকালি গ্রামে নিয়ে আসে। আগের দিন আক্কাস আলী গাজি এই বাড়িতে এসে সব খোঁজখবর নিয়ে যায়।
বিশাল এই বাড়ির চারপাশে ছিল ঘনজঙ্গল। হানাদারদের উপস্থিতি টের পেয়ে লোকজন জঙ্গলের ভিতর গিয়ে আশ্রয় নেন। হানাদার বাহিনী বাড়ির চারদিক থেকে বেড় দিয়ে সবাইকে খুঁজে বের করে। নারী-পুরুষ আলাদা করে নারীদের আঁচল থেকে টাকা-পয়সা, সোনা-গয়না, ঘড়ি-রেডিও ছিনিয়ে নেয়। আর পুরুষদের চৌধুরী বাড়ির সামনের পুকুর পাড়ে নিয়ে উপুড় করে শুইয়ে শক্ত বুটে লাথি মেরে কারও কারও থুতনি কিংবা চোয়াল ভেঙে দেয়। আজানের পর বর্বর হানাদাররা কেদার রায় চৌধুরীর দুই মেয়ে পাখি রায় চৌধুরী, ঝর্ণা রায় চৌধুরী, বিষ্ণুপদ কর্মকারের দুই মেয়ে, ননীপদ কর্মকারের স্ত্রী ও বাঞ্ছারাম পালের স্ত্রীসহ কয়েকজন নারীকে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে পাশের চৌধুরী বাজারের পালকি ঘরে নিয়ে যায়। পালকি ঘরে নিয়ে নারীদের পালাক্রমে ধর্ষণ করে তারা। ভোররাতে হানাদার বাহিনী চৌধুরী বাড়িতে ব্যাপক লুটতরাজ চালায় এবং গানপাউডার ছিটিয়ে দুটি ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২২ জন পুরুষকে হাত ও চোখ বেঁধে লাইন ধরিয়ে সামনের দিকে নিয়ে যায়। তখন এই বাড়ির পরিবারের উদ্বিগ্ন নারীরা জানতে চান, তাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে? তখন হানাদাররা বলে, ‘এদের মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হবে।’
ঘাতকের দল সাতানিখিল বাজারের পূর্বপাশের খালপাড়ে নিয়ে গিয়ে ১৯ জনকে একটি বরুণগাছের নিচে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করায়। হুইসেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে ব্রাশফায়ার শুরু হয়। একেকজনের শরীরে ছয়-সাতটি করে গুলি লাগে। শরীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে ১৭ জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পিঠে ও বাম পায়ে গুলি লাগলেও ডা. চিরঞ্জীবনাথ ভৌমিকের ছোট ভাই জিতেন্দ্রনাথ ভৌমিক (২৩) অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। হানাদাররা কেদার রায় চৌধুরী, ডা. সুরেন্দ্রচন্দ্র সাহা ও ডা. চিরঞ্জীবনাথ ভৌমিককে হরগঙ্গা কলেজের ছাত্রাবাসে নিয়ে গিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ এবং অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এবং সহায়-সম্পত্তির খোঁজখবর নেয়। মুনশি ডেকে জোর করে তাদের মুসলমান বানানো হয়। তাতেও এই তিনজনের শেষ রক্ষা হয়নি। বর্বর হানাদার বাহিনী ডা. সুরেন্দ্রচন্দ্র সাহাকে ১৬ মে সকালে হরগঙ্গা কলেজের পাশে একটি নির্জন ভিটেবাড়িতে খেজুরগাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। ডা. সুরেন্দ্র সাহার প্রতি তাদের এতই ক্ষোভ ছিল যে হত্যার পরও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তার শরীর থেঁতলে দেওয়া হয়।
১০ দিন নির্যাতনের পর ডা. চিরঞ্জীবনাথ ভৌমিক ও কেদার রায় চৌধুরীকে ছেড়ে দিয়ে কঠিন নজরবন্দিতে রাখে। ১০ সেপ্টেম্বর হানাদার বাহিনী কেদার রায় চৌধুরীকে আবার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। ১৯ সেপ্টেম্বর সকালে কাটাখালী বিলে তার লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় ডা. চিরঞ্জীবনাথ ভৌমিক ভয়ে মুন্সিগঞ্জ শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। এতে হানাদাররা তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়। সাভারে খবর পাঠিয়ে তার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। রাজাকাররা তার পৈতৃক বাড়িও দখল করে। কেদার রায় চৌধুরী হত্যাকা-ের পর চৌধুরী বাড়িতে আবার লুটপাট হয়। ভয়ে তার পরিবার ভারতে পাড়ি জমাতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার পর কেদার রায় চৌধুরীর বাড়িও দখল হয়ে যায়। মুন্সিগঞ্জ জেলার গণহত্যা নিয়ে বিস্তারিত জরিপ করেছেন আলোকচিত্রী, শিক্ষক ও গবেষক সাহাদাত পারভেজ। তার জরিপটি ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ মুন্সিগঞ্জ জেলা’ শিরোনামে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছে।