গাইবান্ধা জেলার পলাশবাড়ী উপজেলার বৈরী হরিণমারী গ্রামে গণহত্যা সংঘটিত হয় একাত্তরের ১৭ এপ্রিল। সেদিন পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচ- লড়াই হয়। লড়াইয়ের একপর্যায়ে আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী গুলি করতে করতে মহাসড়ক ধরে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। সাধারণ মানুষকে অনুসরণ করে পাকিস্তানি বাহিনী বৈরী হরিণমারী ম-লপাড়া ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত এলে হঠাৎ তমিজ উদ্দিন, খোরশেদ, সাহেব মিয়া ও আজিজার তাদের সামনে দৌড়ে ‘হাসানের দিঘি’র দিকে পালালে পাকিস্তানি বাহিনী মনে করে তারা মুক্তিযোদ্ধা। তখন তারা ধাওয়া করে এবং তমিজ উদ্দিন, সাহেব মিয়া ও আজিজারকে হাসানের দিঘির পাড়ে গুলি করে হত্যা করে। তারপর পাকিস্তানি বাহিনী হাসানের দিঘি থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলে একটি বাংকার দেখতে পায়। এ বাংকারটি ছিল টিন দিয়ে ঢাকা। পাকিস্তানি বাহিনী বাংকারের ওপর থেকে টিন সরিয়ে ফেললে জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোকে দেখতে পায় এবং সেখানেই তাদের গুলি করে হত্যা করে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে এই বাংকারে আশ্রয় নেওয়া ৪ জন নিরীহ মানুষকে তারা গুলি করে হত্যা করে। আরও অনেকেই গণহত্যার শিকার হন।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘একটি বাংকারে পাকবাহিনী ৪ জনকে দেখতে পেয়ে সেখানেই তাদের গুলি করে হত্যা করে। সেদিন ২টি বাংকারেই ৪ জন করে মোট ৮ জনকে হত্যা করা হয়। হাসানের দিঘির পাড়েও ৩ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। পাক হানাদার বাহিনী বাংকারের মুখের টিনগুলো সরানোর কারণে বৃষ্টির পানি বাংকারে প্রবেশ করেছিল। ফলে রক্ত আর পানি একাকার হয়ে গিয়েছিল।’ তারপরে পাকিস্তানি বাহিনী দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে একটি বাংকারে আশ্রয় নেওয়া তিন সহোদর মফিজ উদ্দিন, রইচ উদ্দিন, কচের উদ্দিন এবং গণি মিয়াসহ মোট ৪ জন সাধারণ মানুষকে একই সঙ্গে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে।
সেদিন তারা যেদিক দিয়ে গেছে সেদিকের বাড়িঘর আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ১০-১২টি বাড়ি বা আনুমানিক ১০০টি ঘর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেখানেও অনেক মানুষ মারা যায়। তারা বৈরী হরিণমারী ও নুনিয়াগাড়ী গ্রামের ৪ জন নারীর ওপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। বৈরী হরিণমারী গ্রামের কেরামত আলীর মেয়ে জ্যোৎস্না নিজ বাড়িতেই পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়। এই গণহত্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন গবেষক মো. সাইফুদ্দীন এমরান। তার ‘বৈরী হরিণমারী গণহত্যা’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র। গবেষক তার গ্রন্থে ১৩ জন শহীদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকাও দিয়েছেন।