কালীগঞ্জের
মোবারকগঞ্জ চিনি কল লাভের মুখ তো দূরের কথা। উল্টো বিশাল অঙ্কের টাকা
ভর্তুকি দিয়ে সরকারকে দিনের পর দিন চালাতে হচ্ছে দক্ষিণের অন্যতম ভারি এই
শিল্প প্রতিষ্ঠানটি। এই মিলটিতে চিনি উৎপাদনের চেয়ে ব্যয়ের খরচ পড়ে যায়
অনেক বেশি। চিনি কলটির এমন বেহাল দশা যে ৬০ টাকায় বিক্রিত এক কেজি চিনি
উৎপাদন করতে সুদ দিতে হয় ৬৯.৫৮ টাকা। উৎপাদনের জন্য আখ ক্রয়, শ্রমিক খরচ,
পরিবহন, যন্ত্র মেরামত ও বিপননসহ যাবতীয় খরচ বাবদ আরো অতিরিক্ত ব্যয় হয়
৬৩.৯৬ টাকা। ওই বছর মিলটি এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে খরচ হয় ১৯৩.৫৮ টাকা।
সুদ বাদে এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে খরচ হয় ১২৩.৯৬ টাকা। আর ১৯৩ টাকায়
উৎপাদিত চিনি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০ টাকায়। ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুমে সরকার
নিয়ন্ত্রণাধিন মোবারকগঞ্জ চিনিকলের চিনি উৎপাদনের চিত্র এরকমই। ওই মৌসুমে
মিলটির লোকসান গুণতে হয় ৯৭ কোটি ২৪ লাখ টাকা। আর মোট লোকসানের মধ্যে ব্যাংক
সুদ পরিশোধ করতে খরচ হয় ৪৯ কোটি টাকা।
এর আগে ২০১৮-১৯ মাড়াই মৌসুমে
মিলটিকে এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে ব্যাংক সুদ দিতে হয়েছিল ৭৮.১১ টাকা। ওই
বছর মিলটি এক কেজি চিনি উৎপাদন করতে সুদ বাদে খরচ হয় ১৩৩.০৩ টাকা আর সুদসহ
উৎপাদন ব্যয় হয় ২১১.১৪ টাকা। ২১১ টাকায় উৎপাদিত চিনি বাজারে বিক্রি হয়েছিল
৫৫ টাকায়। এভাবেই চলছে দক্ষিণের অন্যতম ভারি শিল্প প্রতিষ্ঠান মোবারকগঞ্জ
সুগার মিল। ফলে প্রতিবছরই মিলটি চিনি উৎপাদন ও বিপনন করতে কোটি কোটি টাকার
লোকসান গুনতে হচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলের গুরত্বপূর্ণ এই ভারি শিল্প
প্রতিষ্ঠানটিকে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ মাড়াই মৌসুম শেষে মিলটির প্লাওব্যাক ঋণ
দাড়ায় ৩’শ ৪৭ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। আর এই মোটা টাকার ঋণ মাথায় নিয়ে ২০২০-২১
মৌসুমের আখ মাড়াই শুরু করে গত ১৮ ডিসেম্বর। এর আগে ২০১৮-২০১৯ মৌসুমে মিলটির
লোকসান গুনতে হয় ৭৭ কোটি ৬৯ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। আর দীর্ঘ বছর ধরে এভাবেই
চলছে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জে অবস্থিত ঐতিহ্যবাহী বৃহত চিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান
মোবারকগঞ্জ সুগার মিল। যদিও উৎপাদন খরচের এই টাকার অঙ্কটা একেক বছর একেক
রকম হয়ে থাকে।
এদিকে মিলের রেকর্ড বই বলছে, ২০১৭-২০১৮ মাড়াই মৌসুমে এসে
এই উৎপাদন খরচ ছিল ১৮৯.১৩ টাকা। ২০০১৬-২০১৭ মৌসুমে তা বেড়ে হয় ১৭৪.২৪
টাকা। তার আগের মৌসুম ২০১৫-২০১৬ তে প্রতিকেজি চিনির উৎপাদন ব্যয় হয়েছিল
১৭৬.৪০ টাকা। এই চিনি উৎপাদনে ব্যাংক ঋণের সুদ দিতে হয়েছিল যথাক্রমে ৫৭.৯৩,
৫০.০৬ এবং ৩৩.২৯ টাকা। আর উল্লেখিত বছরগুলোতে চিনির কেজি প্রতি বিক্রয়
মূল্য ছিল ৫০, ৪৭ ও ৪৫ টাকা। এর আগে ২০১৭-২০১৮ ম্ড়াাই মৌসুমে ৭০ কোটি ২৮
লাখ ২২ হাজার টাকা এবং ২০১৬-২০১৭ মৌসুমে লোকসান হয় ৩৫ কোটি ৫৫ লাখ ৯৭ হাজার
টাকা। এ পর্যন্ত ৩৭ মাড়াই মৌসুমে মিলটির লোকশান হয় প্রায় ৪শ কোটি টাকা।
আর সর্বশেষ ২০০৫-২০০৬ মাড়াই মৌসুমে লাভ হয় ৫ কোটি ৮৬ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। এ
নিয়ে মিলের ৫৩ মাড়াই মৌসুমে ১৬ মৌসুমে লাভ হয়েছে ৩৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকা।
সর্বশেষ লাভের মুখ দেখা ২০০৫-২০০৬ মৌসুমে মিলটি ১৩৮ মাড়াই দিবসে এক লাখ ৮১
হাজার ৫৮২ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ১৩ হাজার ৪৩০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন
করে। ওই বছর মিলের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছিল ৯৮৩ জন। কিন্তু বর্তমানে মিলে
কর্মকার্তা ও শ্রমিক কর্মচারী রয়েছে প্রায় ৯শ জন।
বছরের পর বছর
ঐতিহ্যবাহী এ মিলটির মোটা অঙ্কের লোকসানের কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়
চমকপ্রদ সব তথ্য। মিলটির পরিচালনায় অব্যবস্থাপনা, মোটা অঙ্কের ব্যাংক সুদ
প্রদান ও মান্দাতার আমলের ম্যানুয়াল পদ্ধতির কারখানাকে লোকসানের জন্য
প্রধানতম কারন বলছেন মিল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এছাড়া আখের জাতের
কারণে এই লোকসান বাড়ছে বলে মত শ্রমিকদের। অন্যদিকে, চিনি উৎপাদনের সাথে
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিক মজুরী খরচ, আখ ক্রয়, মিলে অপরিষ্কার আখ
সরবরাহ, রস ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত দৈনিক আখ মাড়াই, পরিবহন খরচ, কারখানা
মেরামত এবং বয়লারের জ¦ালানীসহ প্রায় অর্ধশতাধিক খাতের খরচ মিটিয়ে প্রতি
বছরই বাড়ছে চিনি উৎপাদন খরচের এই অংক। সে তুলনায় বাড়েনি চিনির বিক্রয়
মূল্য।
মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার কবীর বলছেন,
পুরাতন যন্ত্রপাতি, কৃষক পর্যায়ে আখের মূল্য বৃদ্ধি, জনবল সংকট, শ্রমিক
মজুরী বৃদ্ধি, দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতি ও উৎপাদন ব্যয়ের সাথে সঙ্গতিহীন
চিনির মূল্য নির্ধারণের ফলে লোকসান বাড়ছে।
সাথে মোটা অঙ্কের ব্যাংক ঋণের
সুদ উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণ বলছেন এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তবে, উৎপাদন
খরচ বেশি হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ও পুষ্টিকর এই খাদ্য
পণ্যটি জনসাধারনে মধ্যে সহনীয় রাখতেই সরকার নির্ধারিত মূল্যে চিনি বিক্রি
করছেন বলে জানালেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার কবীর। উল্লেখ্য, ঝিনাইদহের
কালীগঞ্জ উপজেলা শহরে ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭.৯৩ একর
নিজস্ব জমির উপর নেদারল্যান্ড সরকার মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি স্থাপন করে।
এরমধ্যে ২০.৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮.২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও
শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনী, ২৩.৯৮ একর পুকুর এবং ১০৭ একর জমিতে
পরীক্ষামূলক ইক্ষু খামার।
এছাড়া ১৮.১২ একর জমিতে জুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও
আখ ক্রয় কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠাকালীন মৌসুমে পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ কর্মদিবস আখ
মাড়াই চলে। লক্ষ্য পূরণ হওয়ায় ১৯৬৭-১৯৬৮ মাড়াই মৌসুম থেকে বাণিজ্যিক
ভিত্তিতে উৎপাদন শুরু করে। ঝিনাইদহের ৬ উপজেলা ছাড়াও যশোরের দু’টি উপজেলা
নিয়ে গঠিত মোচিক জোন মিলের আটটি জোনের আওতায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ রয়েছে
সাড়ে তিন লাখ একর। আখ ক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ৪৮টি।