যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপ-আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের টিকা প্রদান চলছে। যেসব দেশ এখনো টিকা নেয়নি তারাও বাজারে চলে আসা নানা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সম্পন্ন করছে। এ অবস্থায় টিকার কার্যকারিতার চেয়ে তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসাবে দেখা দেওয়া এলার্জি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। এলার্জি আতঙ্কে অনেকে টিকা নিতে অনাগ্রহও প্রকাশ করছে। এমনকি বাজারে আসা টিকাগুলোর কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। যদিও স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের মতে, যে কোনো ভ্যাকসিন বা টিকারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে। এ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যগত নানা বিষয় বিবেচনায় নিয়েই টিকা দিতে হয়। তাই বলে টিকার প্রমাণিত কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা সমীচীন হবে না। যেসব টিকা ইতোমধ্যে বাজারে এসেছে সে সবের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকেও তো তাদের টিকা শতভাগ কার্যকরী বলে দাবি করা হয়নি। মহামারি পরিস্থিতিতে ভয়াবহতা কমানোর জন্য তড়িৎভাবে টিকা পরীক্ষা ও সাধারণে প্রদানের ক্ষেত্রে ছোটখাটো সমস্যা থাকবেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে আবিষ্কৃত টিকাগুলো এই মুহূর্তে ভয়াবহতা থেকে বিশ্ববাসীকে বাঁচাবে। এসব টিকার উপরেই সবার ভরসা করতে হবে।
গত ৮ ডিসেম্বর মার্কিন ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজার-বায়োএনটেকের তৈরি টিকা জরুরি ব্যবহারের অনুমতি পায়। ১৪ ডিসেম্বর থেকে সেখানে সর্বসাধারণে টিকা দেওয়া শুরু হয়। এরপর থেকে এ পর্যন্ত ১০ লাখেরও বেশি মানুষ এ টিকা গ্রহণ করেছে। বিশ্বে সবচেয়ে করোনা সংক্রমণের ঘটনা ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে এরইমধ্যে তিন লাখ ত্রিশ হাজারের মতো মানুষের মৃত্যু হয়েছে এ ভাইরাসের সংক্রমণে। ফলে তারা জরুরিভিত্তিতে ফাইজারের টিকা অনুমোদন দেয়।
সর্বশেষ গত ১৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদন দেয় মডার্নার টিকাও। ফাইজার-বায়োএনটেক ও মর্ডানার টিকা গ্রহণের পর করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে পাশর্^প্রতিক্রিয়া হিসেবে এলার্জি দেখা দিচ্ছে। এ নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যমে উঠেছে নানা সমালোচনা। এ অবস্থায় মার্কিন জনগণকে আশ্বস্ত করতে এবং টিকা নেওয়ায় অনুপ্রাণিত করতে গত সপ্তাহেই টিভি সেটের সামনে টিকা গ্রহণ করেছেন দেশটির নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। শুধু বাইডেন নয়, অনেক মার্কিন তারকাও টিকা নিয়ে সাধারণ মার্কিন জনগণকে টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। ফাইজারের টিকা নেওয়ার পর অনেক গ্রহীতার মধ্যে পাশর্^প্রতিক্রিয়া হিসেবে নানা ধরনের এলার্জির দেখা মিলেছে। তবে তার হার খুবই স্বল্প। তবুও কোন খাবার বা ওষুধে কারও অ্যালার্জির ধাত থাকলে তার ফাইজার-বায়োএনটেকের কোভিড-১৯ টিকা নেওয়া উচিত হবে না বলে সতর্ক করে দেয় যুক্তরাজ্যের ওষুধ ও টিকা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এমএইচআরএ। ৮ ডিসেম্বর এই টিকা নিয়ে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) দুই কর্মীর অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দেওয়ার পর এ সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। ওই দুই কর্মীই জানিয়ে তাদের মারাত্মক অ্যালার্জির ধাত আছে।
এমএইচআরএ’র প্রধান নির্বাহী জুন রাইনে এক বিবৃতিতে জানান, কারও কোনও টিকা, ওষুধ কিংবা খাবারে অ্যানাফিল্যাক্সিস এর ইতিহাস থেকে থাকলে তার এই কোভিড টিকা নেওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতিক্রিয়া সচরাচর দেখা যায় না। তবে ফ্লুয়ের টিকাসহ অন্যান্য টিকার ক্ষেত্রে এমন হতে পারে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে ফাইজারের টিকা ৯৫ শতাংশ কার্যকর। প্রতি ১শ জনের মধ্যে ৫ জনের সমস্যা হতেই পারে। মহামারির মতো জরুরি সময়ে এ ঘাটতি বড় কোনো বিষয় নয়। কিন্তু টিকার কার্যকারিতার চেয়ে টিকা নিয়ে এলার্জির মতো যে সমস্যাগুলো ঘটছে সেগুলোই বারবার সামনে আসছে। আর এতে মানুষের মধ্যে আতঙ্কা ও অনাস্থা তৈরি হচ্ছে। কার্যকারিতার ক্ষেত্রে ৯৪ শতাংশ দাবি করা মডার্নার ভ্যাকসিন বা টিকায়ও এলার্জিও মতো পাশর্^প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে গত শুক্রবার। গত বৃহস্পতিবার হোসাইন সরজাহেদ নামের এক মার্কিন চিকিৎসক মডার্নার টিকা গ্রহণ করে এবং শুক্রবার তার শরীরে এলার্জির সমস্যা দেখা দেয়। তবে এখনো পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো সমস্যা হয়নি। তিনি সুস্থ আছেন। চিকিৎসক সদরজাদেহ জানান, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেই তার মাথা ঘোরা শুরু হয় এবং হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়। দুই টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে এলার্জির সমস্য দেখা দেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের ফুড এন্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের পক্ষ থেকে তদন্ত করা হচ্ছে। এদিকে কোনও ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া এখনও পর্যন্ত কোনও কার্যকরী ওষুধ হাতে নেই বলে দাবি করেছেন লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ইমিউনোলজি বিভাগের বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক পিটার ওপেনশ’। তিনি বলেন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ঝুঁকি এবং সুবিধার দিকটিতে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।
স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, এলার্জির সমস্যা থাকলে এসব টিকা এই মুহূর্তে নেওয়া উচিৎ হবে না। তাদেরকে সে সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করা উচিৎ যতক্ষণ পর্যন্ত এলার্জির কারণে আসলে কি ঘটছে তা নিশ্চিত হওয়া না যায়। প্রথম দেশ হিসেবে ৮ ডিসেম্বর যুক্তরাজ্য করোনাভাইরাসের টিকা দেওয়া শুরু করার পর ১৪ ডিসেম্বর থেকে টিকা দেওয়া শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও কানাডা। এরপর সৌদি আরব, ইসরায়েল, কাতার, মেক্সিকো, সার্বিয়া, কুয়েত, চিলি, রাশিয়া, কোস্টারিকা ও ক্রোয়েশিয়াতে টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের টিকা আনার সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রেজেনেকার ৩ কোটি ডোজ করোনা ভ্যাকসিন আগামী জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে দেশে আসছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, ভ্যাকসিন দেশে আসার পর এর মজুত, সরবরাহ এবং সঠিকভাবে বিতরণের সার্বিক প্রস্তুতিও ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অক্সফোর্ডের টিকা মাইনাস ২ ডিগ্রি থেকে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রাখতে হবে। অর্থাৎ, ইপিআই টিকার মতো একই তাপমাত্রায় রাখা যাবে। প্রতিটি জেলায় টিকা রাখার জন্য পর্যাপ্ত ফ্রিজ আগে থেকেই আছে। নতুন করে আরো কিছু ফ্রিজ কেনা হয়েছে। পাশাপাশি যারা টিকা দেবেন, তাদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রথম দফায় টিকা আনা হচ্ছে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউট থেকে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা কোম্পানি এই টিকা তৈরি করছে, যা ভারতের প্রতিষ্ঠানটিতেও উৎপাদন হচ্ছে। বেক্সিমকোর মাধ্যমে এই টিকার ৩ কোটি ডোজ কিনতে সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি করেছে সরকার। মহামারি মোকাবিলায় যারা সামনে থেকে কাজ করছেন, শুরুতে তাদের এই টিকা দেওয়া হবে। বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানার পর ভ্যাকসিন গ্রহণের ক্ষেত্রে এরইমধ্যে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যেও নানা বিভ্রান্তি কাজ করছে।
অনেকে বলছেন, ফাইজার বা মডার্না বা অক্সফোর্ডের করোনার ভ্যাকসিন নিতে তারা আগ্রহী নন। তাদের দাবি, এটা ফার্স্ট জেনারেশন ভ্যাকসিন। আমাদের দেশে ইপিআই বা অন্যান্য ভ্যাকসিন যেগুলো নেওয়া হচ্ছে, তার বয়স নিদেনপক্ষে পাঁচ থেকে ১০ বছর অথবা তারও বেশি। আবার প্রতিবছর সেগুলো রিফাইন করা হয়, অ্যাডভান্স ইফেক্ট দেখে সেগুলোর এফিকেসি (কার্যকারিতা) বাড়ানোর জন্য গবেষণা করা হয়। কিন্তু যেখানে কিছু স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভাইরাস প্রতিরোধ করা যেতে পারে, সেখানে সেখানে ভবিষ্যৎ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না জেনে ভ্যাকসিন (ইনজেকশন) নেওয়ার কোনও মানে হয় না। এটা তো খাওয়ার ওষুধ নয় যে রক্তের সঙ্গে না মিশে বের হয়ে যাবে, এটা ইনজেকশন। কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, ভ্যাকসিন যত দামি হোক না কেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রি-কোয়ালিফিকেশন লাগবে। কিন্তু অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন এখনও প্রি-কোয়ালিফিকেশন পায়নি। আবার ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের সাতটি দেশের মধ্যেও সেটা যদি অনুমোদন হয়, সে দেশগুলোর কোনও একটাতেও যদি ব্যবহার শুরু হয়, তাহলে আমাদের আইনে রয়েছে আমাদের দেশের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর অনুমোদন দেবে। সেই আলোকে ডিসেম্বরের শেষে ভারতের রেগুলেটরি বডি অনুমোদন দেবে। তারপর অক্সফোর্ড যুক্তরাজ্য সরকার এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে অনুমোদন চাইবে। যখনই আমরা অনুমোদন শুনবো, তখনই সেটা আনা হবে।
ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকেরই অনাগ্রহ রয়েছে এটা সত্যি মন্তব্য করে অধ্যাপক ডা. শহীদুল্লাহ বলেন, ‘সারা পৃথিবীতেই এরকম মানুষ রয়েছে। এটা এ দেশেও হবে। পৃথিবীতে অনেক ‘অ্যান্টি ভ্যাকসিন ক্যাম্পেইন গ্রুপ’ রয়েছে, যেখানে ধর্মান্ধ যেমন রয়েছে তেমনি নানান ট্যাবু কাজ করে মানুষের মধ্যে। তারা খুব সক্রিয়, তবে বাংলাদেশ সেখান থেকে ভালো অবস্থানে রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কেউ স্বাভাবিকভাবে ইমিউন হওয়ার আশা করেন আর বিশেষ করে করোনা ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে অনেকের ধারণা, খুব তাড়াতাড়ি এই ভ্যাকসিন তৈরি হয়েছে, তাই ভবিষ্যতে তার কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে সেটা এখনও অজানা। একেক জনের একেক কারণ রয়েছে, সবার অনাগ্রহ কিন্তু এক কারণে নয়’।
স্বাস্থ্য বিভাগের টিকা সম্পর্কিত কার্যক্রমের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা টিকা নেবে না তাদের প্রাথমিকভাবে বাইরে রেখে যারা টিকা নেবেন তাদের হলফনামা দিতে হবে যে এই ভ্যাকসিন তারা স্বেচ্ছায় নিচ্ছেন।’ টিকা নিয়ে অনাগ্রহ কাজ করছে অনেকের মধ্যে, এ নিয়ে সরকারের কোনও পরিকল্পনা রয়েছে কিনা জানতে চাইলে ভ্যাকসিন বিষয়ক গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির
সদস্য ডা. শামসুল হক বলেন, ‘সেটা থাকতেই পারে। আর এটা পুরোটা নির্ভর করবে যখন টিকার সব তথ্য আমরা পেয়ে যাবো।
তিনি বলেন, আমরা যদি মানুষকে বোঝাতে পারি মানুষের কোনও অনাগ্রহ থাকবে না। আমরা পজিটিভ আছি, এ নিয়ে প্রচারণা চালানো হবে, কাজ করবো আমরা। তবে মানুষের শরীরের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে।’