শ্রীপুর-সোনাপুর দুটো পাশাপাশি গ্রাম। নোয়াখালী জেলার সদর উপজেলাতেই এই দুটো গ্রাম অবস্থিত; নোয়াখালীর পুরাতন শহরসংলগ্ন ছিল বলে এখানে নোয়াখালীর অনেক সুধীজনের আনাগোনা ছিল। ১৯৭১ সালের ১৫ জুন সকালে পাকিস্তানি বাহিনী চন্দ্রগঞ্জ আক্রমণ করে। তারা সেখানে অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। চালায় বীভৎস এক গণহত্যা। একই দিন আনুমানিক বেলা দুইটাতে শ্রীপুর, সোনাপুর, করিমপুর গ্রামের পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে। অবিরাম গুলির শব্দে জীবন বাঁচাতে সবাই দিক-বিদিক পালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তানি বাহিনী পুরো গ্রাম এবং সোনাপুর বাজার ঘিরে ফেলে। অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সোনাপুর ডাকবাংলোর সামনে অবস্থান নিয়ে কয়েকটি দলে ভাগ হয়ে গ্রামগুলোতে প্রবেশ করে।
একটি দল আহম্মদিয়া আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মো. ইয়াছিন, তোতা মিয়া ও আলী হোসেনকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা বিদ্যালয়ের পেছনের সৈয়দ মুন্সী বাড়িতে প্রবেশ করে আলী করিম, আলী হায়দার ও তাদের এক অতিথিকে গুলি করে হত্যা করে। এরপর তারা লুটপাট করে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আক্রমণ চালায় হাজী আবদুল বারীর বাড়িতে। সে বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী নূর মুহাম্মদ এবং আবদুল রহমানকে হত্যা করে। সে সময় মুহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল গুলিবিদ্ধ হন। তাদের বসতঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। শ্রীপুরে আরো যারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে হত্যার শিকার হন তারা হলেন আবু তাহের, আবদুর রাজ্জাক, আজিজ আহম্মদ, মজিবুল হক ভূঞাসহ আরো অনেকে। করিমপুর গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে প্রবেশ করে পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা, নির্যাতন ও আগুন দিয়ে বসতঘর পুড়ে ফেলে। পাকিস্তানি বাহিনী সেন পুকুর পাড়ে এসে ঘাটলায় গোসল করতে আসা কয়েকজনকে হত্যা করে। এখানে এসে তারা দুটি দলে ভাগ হয়ে যায়। একটি দল উত্তরে, আরেকটি দল দক্ষিণে আবদুল মজিদ চৌকিদার বাড়িতে আক্রমণ করে। মো. হুমায়ুন কবির, সাব্বির আহম্মদ, মো. আবুল খায়ের, চৌধুরী মিয়া ও বাচ্চু মিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে। উত্তরের দলটি পর্যায়ক্রমে কয়েকটি বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে হত্যা-নির্যাতন ও বসতঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং তাদের সহযোগীরা লুটপাট করে। এখানে নারীদের শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটে। শ্রীপুর ও সোনাপুর গ্রামে প্রবেশ করা পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে আরো একটি দল সোনাপুর বাজারে আক্রমণ চালায়। গুলি করে আগুন লাগিয়ে তারা মুহূর্তে ৫০০ গজ এলাকা নরকে পরিণত হয়, দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন।
পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণে নির্যাতিত হন পনেরোর অধিক নারী। প্রতিবাদ, প্রতিরোধহীন সোনাপুর বাজার ও চারপাশের গ্রামে নেমে আসে কবরের নিস্তব্ধতা। সবচেয়ে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে দক্ষিণ সোনাপুর ডা. আবদুল কাইয়ুমের ওষুধের দোকানে। সেখানে এক মা তার ২ মাসের অসুস্থ শিশুকন্যাকে নিয়ে আসে ডাক্তারের কাছে। এ সময় হানাদাররা প্রথমে ডাক্তারকে, পরে মা ও শিশুকে গুলি করে হত্যা করে এবং গানপাউডার দিয়ে সব পুড়িয়ে ফেলে। এতে ডাক্তার, মা ও শিশু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ তা-বলীলা প্রায় দুই ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। শ্রীপুর ও সোনাপুর গণহত্যা নিয়ে গবেষণা করেন এ. কে. এম. গিয়াস উদ্দিন মাহমুদ। ‘শ্রীপুর-সোনাপুর গণহত্যা’ শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র। গবেষক ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য তুলে ধরার পাশাপাশি প্রায় ৪০ জন শহীদের একটি অসম্পূর্ণ তালিকাও দিয়েছেন।