মহান বিজয় বাঙালির আত্নপরিচয়ের চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের দিন। এদিন সকল দেশপ্রেমিক বাঙালির হৃদয়ে গাঁথা থাকে লাল-সবুজের পতাকা। কিন্তু গেল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) কয়েকজন শিক্ষক কর্তৃক জাতীয় পতাকা বিকৃত করে ফটোসেশন করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার পর তা নিয়ে নানা সমালোচনা আলোচনা শুরু হয়। এমন গর্হিত ঘটনার রংপুর জেলা প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিষয়টির সত্যতা পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশসহ এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মেজর নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহর কাছে পাঠানো হয়েছে।
এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের পক্ষ থেকেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে পতাকা বিকৃতির নেপথ্যে ছিলেন কে বা কারা ছিলেন, সেটি বের করে আনা হয়েছে। ভোরের পাতার অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে মূল হোতার নাম। তিনি হচ্ছেন অস্তিত্ববিহীন নীলফামারীর সৈয়দপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বে-আইনী কাজে লিপ্ত এবং বেরোবির গনিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান। বিতর্কিত ও জামায়াতপন্থী শিক্ষক হিসাবে তিনি ইচ্ছে করেই মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অবস্থান করা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহসহ পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান ক্ষুন্ন করতেই এমন হীন কাজ করেছেন বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
মশিউর রহমানের একজন সহকর্মী ভোরের পাতাকে বলেন, সেদিন আমিও পতাকা বিকৃতির সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাম। কিন্তু পতাকাটি বিকৃত করার মাস্টারমাইন্ড হিসাবে কাজ করেছেন মউশির রহমান। তিনি এমন সূক্ষ্ণভাবে ষড়যন্ত্রটি করেছেন, কেউ যেন বুঝতেই না পারেন , সেদিকে তার চতুরতা ছিল অন্য রকমের। গোপনে পতাকাটি আনিয়ে এই মশিউরই সবার হাতে তুলে দিয়ে ফটোশেসন করিয়েছিল। এই পরিকল্পনা তিনি জামায়াত-বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের পরমার্শেই করেছেন বলে জানা গেছে।
একাধিক শিক্ষক ভোরের পাতাকে বলেছেন, বেরোবিতে মুখে মুখে আওয়ামী লীগপন্থী অনেক শিক্ষক আছেন যারা গোপনে বিএনপি-জামায়াতপন্থী। তারা এখনো মৌলবাদী পাকিস্তানের ভাবধারা অন্তরে ধারণ করেন। তাদের মধ্যে গণিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান অন্যতম। তিনি এমন হীন কাজ করে দেশবাসীর কাছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে বিতর্কিত করেছেন। এটার জন্য তার শাস্তি পাওয়া জরুরি। ভবিষ্যতে যেন এমন কাজ কেউ না করতে পারে, সেদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকেও আরো কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষকরা।
ইউজিসির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেস রিলিজ দিয়ে এ ঘটনায় বলা হয়েছে, অস্তিত্ববিহীন সৈয়দপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বে-আইনী কাজে লিপ্ত বেরোবির গনিত বিভাগের শিক্ষক মশিউর রহমান সহ আরও অনেকে এমন হীন ঘটনায় জড়িত। এমনকি সম্প্রতি বেরোবির জাতীয় পতাকা সংকটে সে এক মামলার বাদীপক্ষ। সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দ এই দুমূখোদের নিয়ে উদ্বিগ্ন; অনেকের মতে যে শিক্ষক নিজেই বে-আইনি কাজে যুক্ত, নৈতিকতার বিষয়ে অজ্ঞ তার দ্বারা সবকিছুই সম্ভব। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক সুশীল সমাজের প্রতিনিধি আক্ষেপ করে বলেন, “মশিউরদের বিচার করবে কে?
নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক শিক্ষক বলেন- ক্যাম্পাসে ভিসি মহোদয়ের একান্ত চেষ্টা সত্ত্বেও কিছু নামধারী শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়ে জন্ম দিচ্ছেন একের পর এক বিতর্ক এবং তারই একটা প্রচেষ্টা হচ্ছে পতাকা বিতর্ক। একাডেমিক কাজে তাদের মন নেই; দলাদলি, কোন্দলেই তারা বেশি ব্যস্ত।
এছাড়া, এ ঘটনার পরই রংপুর জেলা প্রশাসক আসিব আহসান জানান, জাতীয় পতাকা বিকৃতির ঘটনায় রংপুর জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট গোলাম রব্বানী মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে জাতীয় পতাকা বিকৃতির প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, সে কারণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
গত বৃহস্পতিবার গঠন করা ওই কমিটির অন্য সদস্যগণ হলেন, মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু এবং মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী পুলিশ কমিশনার জিন্নাহ আল মামুন।
এদিকে, পতাকা অবমাননার ঘটনার ৫দিন পর ব্যাপক সমালোচনার মুখে ঢাকাস্থ লিঁয়াজো অফিসে সিন্ডিকেটের বিশেষ সভায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এতে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নাজমুল ইসলামকে আহ্বায়ক, প্রক্টর আতিউর রহমানকে সদস্য সচিব এবং একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য সুচিতা সুচিত্রা শারমিনকে সদস্য করা হয়েছে।
এদিকে, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক জাতীয় পতাকাকে ‘ব্যানার’ আখ্যা দিয়ে প্রকৃত ঘটনার অপব্যাখ্যা করে জাতীয় পতাকা অবমাননার বিষয়টি ভিন্নখাতে প্রবাহের তীব্র নিন্দা, প্রতিবাদ এবং তদন্তের নামে প্রহসনমূলক তদন্ত কমিটি প্রত্যাখান করেছে ‘অধিকার সুরক্ষা পরিষদ’ নামে শিক্ষকদের একটি সংগঠন। বুধবার সংগঠনটির আহ্বায়ক প্রফেসর ড. মো. মতিউর রহমান ও সদস্য সচিব খায়রুল কবির সুমন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটি প্রত্যাখান করেছে ‘অধিকার সুরক্ষা পরিষদ’। একইসাথে পতাকা অবমাননার ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেন ‘অধিকার সুরক্ষা পরিষদ’-এর নেতৃতৃন্দ।
প্রসঙ্গত, বিজয় দিবসের দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক একটি বিকৃত জাতীয় পতাকার সামনে নিয়ে ফটোসেশন করে ফেসবুকে দেয়ার প্রতিবাদে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে দোষীদের শাস্তির দাবিতে ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে রংপুর মহানগর আওয়ামী লীগ, বেরোবি ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে বিক্ষোভ-সমাবেশ, মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন হচ্ছে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষক ও একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তাজহাট থানায় পৃথক দুটি এজাহার করেছেন।
সৈয়দপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়টি অস্তিত্ববিহীন চাকরি প্রত্যাশী ও শিক্ষার্থীদের সর্তক থাকার পরামর্শ ইউজিসি’র সৈয়দপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় নামে কোন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব নেই। এটি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনপ্রাপ্তও নয়। ইউজিসি’র বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় নামে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব সম্পর্কে কমিশন অবগত নয়।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় নামক কোন প্রকল্প প্রস্তাবও ইউজিসিতে প্রেরণ করা হয়নি। অস্তিত্ববিহীন এ প্রতিষ্ঠানটির অবৈধ কার্যক্রম বন্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের সহায়তা চেয়েছে ইউজিসি। এ বিষয়ে শিগগিরই একটি গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করবে ইউজিসি। বিশ্ববিদ্যালয়টির উদ্যোক্তা ও প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর (ভারপ্রাপ্ত) পরিচয়দানকারী অধ্যাপক ড. এ বি এম শরিফুজ্জামান শাহ সম্প্রতি প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ও শিক্ষকসহ বিভিন্ন পদে জনবল নেওয়া হবে উল্লেখ করে জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দেখানো হয়েছে সংসদ সদস্য (৩২৩ মহিলা আসন) জনাব রাবেয়া আলীম-কে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সংবাদ, জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তিসহ বিভিন্ন বিষয় ইউজিসি’র দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকবৃন্দ ও চাকরি প্রত্যাশীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারে সর্তক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি। আগ্রহীরা প্রয়োজনে ইউজিসি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা ও অনুমোদিত প্রোগামের তালিকা অবলোকন করতে পারেন। উল্লেখ্য, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০’ অনুযায়ী মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর মেয়াদে ভিসি, প্রো-ভিসি এবং কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দেন। কাজেই এসব পদে কোন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাউকে নিয়োগ প্রদান করলে তা হবে সম্পূর্ণ আইন পরিপন্থী। এছাড়া উপাচার্যবিহীন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রোগ্রামের প্রদত্ত সাটিফিকেটও অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হবে।