বস্তায় ভরে মিলের জ্বলন্ত বয়লারে পুড়িয়ে মারা হতো শ্রমিকদের
আরিফ রহমান
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:৫৯ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর টার্গেট ছিল ব্যাপক গণহত্যা চালানো। খুলনার খালিশপুর ছিল শ্রমিক এলাকা। এই সব এলাকায় হানাদার বাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা চালায়। আশপাশের এলাকার শ্রমিকরা ছিল গণহত্যার প্রাথমিক টার্গেট। এর বাইরেও দূর-দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষকে ধরে এনে জুটমিল ও সুগার মিলগুলোতে হত্যা করা হতো। মিলের ভেতরের বড়বড় কক্ষগুলোকে ব্যবহার করা হতো নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে। মিলগুলো গড়ে উঠেছিল নদীর তীর ঘেঁষে। ফলে নির্মমভাবে মানুষ হত্যা করার পর তাদের সমাহিত করার ঝামেলা করতে হতো না পাকিস্তানিদের। তারা সরাসরি লাশগুলো নদীর পানিতে ভাসিয়ে দিতে পারতো। একাত্তরের দুর্বিষহ দিনগুলোতে এইসব মিলে যাদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো সেইসব হতভাগ্যদের আত্মীয়-স্বজন নদীর অন্যপ্রান্তে বসে থাকতো যদি লাশ ভেসে আসে এই আশায়। আজকে আমরা খুলনার খালিশপুর এলাকার দুটি বড় বড় জুটমিলে সংগঠিত গণহত্যা সম্পর্কে জানব।
খালিশপুরের ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলটি ছিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ নির্মমতার এক নাম। এখানে নিরীহ মুক্তিপাগল বাঙালিদের হত্যার ধরন বিশ্বের যে কোন নির্মমতাকে হার মানায়। এখানে নানাভাবে নির্যাতনের একটি ছিল মিলের জ্বলন্ত বয়লারে মানুষ পুড়িয়ে মারা। নিরীহ লোকদের প্রথমে জীবিত অবস্থায় বস্তায় ভরা হতো তারপর সেই বস্তা পায়ের দিক থেকে জ্বলন্ত বয়লারে ঢুকানো হতো। এভাবেই জীবিত পুড়িয়ে মারা হতো নিরীহ লোকগুলোকে। বিভিন্ন সময়ে এখানে মিলের ৬০ জন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল বলে জানা যায়। এদিকে খুলনার ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত পিপলস জুট মিল মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যা নির্যাতনের আরেক নিদর্শন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ে এখানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং বিহারীরা মিলটি গণহত্যা, নির্যাতন ও বধ্যভূমিতে পরিণত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়ে এখানে অসংখ্য নিরীহ বাঙালিকে ধরে এনে নির্যাতন ও হত্যা করা হতো। এ হিসেবে এখানে বহুবার গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। ১৯৭২ সালে খালিশপুর এলাকায় অননুমোদিত অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করতে গিয়ে পুলিশ পিপলস জুট মিলের মধ্যে থেকে অসংখ্য নরকঙ্কাল উদ্ধার করে। মিলের শ্রমিক কলোনির ল্যাট্রিনের সেফটি ট্যাংকের মধ্যে দু’হাজারেরও বেশি কঙ্কালের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই সময়ের সংবাদপত্র দৈনিক বাংলার ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সংখ্যায় লেখা হয়েছেÑ ‘অননুমোদিত অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারের ব্যাপক তল্লাশী চালানোর সময় পুলিশ পিপলস জুটমিলের ভেতরে শ্রমিক কলোনি ল্যাট্রিনের সেফটি ট্যাংকের মধ্যে প্রায় দুই হাজারের অধিক বাঙালি শ্রমিকের কঙ্কাল পেয়েছে। মানুষের দেহের এসব কঙ্কাল থেকে বুঝা যায়, মারার পূর্বে তাদের হাত-পা বাঁধা ছিল।’ ১৯৭১ সালে এভাবেই বাংলার নরম মাটি শহীদের লাল রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল। এই গণহত্যার নির্মমতা হার মানিয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসের সব নির্মমতাকে।