প্রকাশ: শুক্রবার, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১০:৪৮ এএম আপডেট: ২৫.১২.২০২০ ১:৫৪ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
মুসলমানদের জন্য দুনিয়ার বুকে সবচেয়ে বড়ো নেয়ামত হচ্ছে কুরআন। এ কুরআনকে আল্লাহ পাক মুসলিম জাতির কাছে একইসাথে একটি ধর্মীয় গ্রন্থ এবং একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিশেবে নাযিল করেছেন। বড়ো মজার ব্যাপার হলো, এটি একটি ধর্মীয় গ্রন্থ ও জীবনবিধান হলেও (বুঝে হোক কিংবা না বুঝে) এর তিলাওয়াতের ব্যাপারে রয়েছে অসংখ্য ফযিলত। কিন্তু আক্ষেপের কথা হলো, হাদিস শরিফে এর বহু ফযিলত বর্ণনা সত্ত্বেও কুরআন তিলাওয়াতের পরিমাণ দিনদিন শঙ্কাজনক হারে কমেই চলেছে। একটা সময় ছিল যখন কুরআন তেলাওয়াত ছাড়া মুসলামানদের দিন শুরু হওয়ার কল্পনাই করা যেতো না। আর সেখানে বর্তমান দুনিয়ার প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মুসলমান শুদ্ধরূপে কুরআন তিলাওয়াতেই সক্ষম নন। তাই হাদিসের আলোকে কিছু ফযিলতের বর্ণায়ন এব্যাপারে মুসলমানদের সচেতনতা বৃদ্ধি করবে বলে আশা রাখি।
কুরআন হিফজের মর্যাদা:
কুরআনে কারীম হিফজ বা মুখস্থ করা একটি ধারাবাহিক সুন্নত। হাদিসে আছে, জিবরাইল আমিন আলাইহিস সালাম রমযানের প্রতিরাতে রাসূলের কাছে আসতেন এবং রাসূল (সা.) সারারাত ব্যাপী তাঁকে কুরআনে কারীম মুখস্থ শোনাতেন। (বুখারী, মুসলিম)।
কুরআন তার সংরক্ষক তথা হাফেজকে জান্নাতের উচ্চাসনে আসীন করে দেবে। যেমন হাদীসে এসেছে, কেয়ামতের দিন হাফেজে কুরআনকে বলা হবে, তুমি দুনিয়ার মতো করে ধীরে ধীরে সুন্দর ও সুললিত সুরে কুরআন তেলাওয়াত করো এবং সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকো। কেননা সেখানেই তোমার বাসস্থান যেখানে পৌঁছে তুমি কুরআনের শেষ আয়াতটি তেলাওয়াত করবে।
একজন হাফেজে কুরআন হলেন সর্বোচ্চ সম্মান এবং মর্যাদার উপযুক্ত। হাদিসে যেমন বর্ণিত হয়েছে, অবশ্যই আল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন হলো বৃদ্ধ মুসলামানের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, কুরআন সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে না এমন হাফেজকে মর্যাদা দান এবং ন্যায়পরায়ন শাসকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন। (সুনানে আবি দাঊদ : ৪৮৪৫)
কুরআন হিফজকারীগণ আল্লাহর পরিবার এবং ‘খাস’ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত। হাদিসে এসেছে, নবী কারীম সা. বলেছেন, নিশ্চয়ই মানব জাতির মধ্যে আল্লাহর দুটি পরিবার রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করলেন, তারা কারা? রাসূল (সা.) বললেন, কুরআনকে যারা নিজেদের পরিবারভুক্ত করতে পেরেছে।
কুরআনের হাফেজের জন্য দুনিয়াতেও রয়েছে প্রচুর সম্মান। উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ পাক এই গ্রন্থ তথা কুরআন মাজীদ দ্বারা (তার উপর আমলকারী) জনগোষ্ঠীর উত্থান ঘটান আবার এরই দ্বারা (এর অবাধ্য) অন্য গোষ্ঠীর পতনও সাধন করেন। (সহিহ মুসলিম : ৮১৭)
তবে সবকিছু ছাড়িয়ে একজন হাফেজে কুরআনের জন্য সবচেয়ে বড়ো সুসংবাদ হলো, সে জাহান্নামে যাবে না। রাসূলে পাক (সা.) বড়ো চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়ে এটি বুঝিয়েছেন যে, কুরআনকে যদি কোনও চামড়ায় রাখা হয় এবং তা আগুনে নিক্ষেপ করা হয় তবে তা কখনোই জ্বলবে না।
আবার একজন কুরআনের হাফেজ ব্যক্তি নামাজের জামাতেও ইমাম হওয়ার অধিক উপযুক্ত। যেমনটি হাদিসে এসেছে যে, অধিক শুদ্ধ তেলাওয়াতকারী ব্যক্তিই জামাতের ইমামতির হকদার। (সহিহ মুসলিম)।
কুরআন তিলাওয়াতের মর্যাদা :
কেয়ামতের দিন কুরআন তার হিফজ এবং সংরক্ষণকারীদের জন্য সুপারিশ করবে। নবী কারীম সা. বলেছেন, তোমরা কুরআন তেলাওয়াত করো। কেননা কুরআন কেয়ামতের দিন তার তেলাওয়াতকারীদের জন্যে সুপারিশকারী হিসেবে আগমন করবে। (মুসলিম : ৮০৪)।
অনুরূপভাবে ঈর্ষার কথাও বলা হয়েছে যে, প্রকৃত ঈর্ষা কেবল কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রেই করা যেতে পারে। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সা. বলেন, দুটি জিনিসেই কেবল ঈর্ষা করা যায়। এক. কোনও ব্যক্তিকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন তেলাওয়াতের সৌভাগ্য দান করেছেন। ফলে সে দিন-রাত কুরআন তেলাওয়াত করে এবং তা মেনে চলে। (বুখারী-মুসলিম)।
যে ব্যক্তি যতোবেশি কুরআন তেলাওয়াত করবেন তার ততোবেশি সওয়াব জমা হত থাকবে। হযরত রাসূলে কারীম সা. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করবে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হবে। প্রতিটি নেকি হবে দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। (সুনানে তিরমিযি)।
কুরআন হিফজ ও তেলাওয়াত করা দুনিয়া ও তার সবকিছু হতে উত্তম। রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সকালে মসজিদে দুটি আয়াত শিখে বা পাঠ করে, তাকে দুটি উট সদকা করার সওয়াব দেয়া হবে। তিনটি করলে তিনটি এবং চারটি করলে চারটি। এভাবে যতোবেশি আয়াত সে তেলাওয়াত করবে, ততোবেশি উট সদকা করার সওয়াব তাকে প্রদান করা হবে। (সহিহ মুসলিম)।
হযরত আবূ মূসা আশ‘আরী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, কুরআন পাঠকারী মুমিন হচ্ছে ঠিক কমলা লেবুর মতো; যার ঘ্রাণ উওম এবং স্বাদও উওম। আর যে মুমিন কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক খেজুরের মত; যার (উত্তম) ঘ্রাণ তো নেই, তবে স্বাদ মিষ্ট। (অন্যদিকে) কুরআন পাঠকারী মুনাফিকের দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুগন্ধিময় (তুলসি) গাছের মত; যার ঘ্রাণ উওম কিন্তু স্বাদ তিক্ত। আর যে মুনাফিক কুরআন পড়ে না তার উদাহরণ হচ্ছে ঠিক মাকাল ফলের মত; যার (উত্তম) ঘ্রাণও নেই আবার স্বাদও তিক্ত। (বুখারী : ৫০২০; মুসলিম : ৭৯৭)
কুরআন শেখার মর্যাদা :
কুরআনে দক্ষ ব্যক্তি সুউচ্চ মর্যাদার অধিকারী। হাদিসে এসেছে, কুরআনে দক্ষ ও প-িত ব্যক্তি সম্মানিত পুণ্যবান ফেরেশতাদের সাথে থাকবেন। (মুসলিম)।
উসমান ইবনে আফফান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, তোমাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি সে-ই যে নিজে কুরআন শেখে ও অপরকে শেখায়। (বুখারী : ৫০২৭)
এখন প্রশ্ন সচেতন মুসলমানদের মহিমান্বিত বিবেকের কাছে, হাদিসে বর্ণিত এই এতো এতো ফযিলতের কথা জানার পরও কি তাদের টনক নড়বে না? তবু কি তারা কুরআন তিলাওয়াতে মনযোগী হবে না? হাদিসে এসেছে, কুরআন কেয়ামতের দিন আপনার পক্ষেও যেতে পারে আবার বিপক্ষেও। সিদ্ধান্ত আপনার।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক