প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্যপুত্র এবং তাঁর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যেখানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাকে ডিজিটাল বাংলাদেশে পরিণত করেছেন; ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার এক যুগ পূর্তিও হয়েছে। তখনই সরকারের ভেতরে থাকা কিছু অসাধু মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী ও আমলার যোগসাজসে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত ফ্লোরা টেলিকমের কর্ণধার মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউকের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ উঠেছে। তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকো যেমনভাবে অর্থপাচার করেছিল, ঠিক তেমনি আওয়ামী লীগের ছদ্মবেশ ধারণ করে রফিকুল ইসলাম ডিউক শত কোটি টাকার বেশি অর্থপাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সংঘবদ্ধ একটি সিন্ডিকেটের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে আওয়ামী লীগের লেবাসধারণ করা মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউক, যিনি অর্থপাচারের কারণে দুবাইয়ে পালিয়ে আছেন, তার নানা ষড়যন্ত্র আর অপকর্মের খতিয়ান নিয়ে ভোরের পাতার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
ভোরের পাতার অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথমসারির একটি ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে জটিলতার সৃষ্টি হয়। জটিলতা তৈরি করেছে ফ্লোরা টেলিকম। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার আপডেট না করেই ব্যাংকের একজন ডিজিএমের স্বাক্ষর জাল করে সফটওয়্যার জালিয়াতির মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া ফ্লোরার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও রয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, ওই ব্যাংকের দুইজন আমানতকারী হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করার প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে কোর ব্যাংকিং সফটওয়ার সম্পর্কিত ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের দুর্নীতি ও বেআইনি কর্মকা- তদন্ত এবং ওই ব্যাংককে তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন হাইকোর্ট বরাবর দাখিল করার নির্দেশনা দিয়েছেন।
রিটকারীদের আইনজীবী ব্যরিস্টার এ বি এম হামিদুল মিসবাহ গণমাধ্যমকে জানান, গত ৩০ নভেম্বর হাইকোর্ট ফ্লোরা টেলিকম লি. কর্তৃক রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার আপগ্রেডেশন, রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবা প্রদানে দুর্নীতি, মানিং লন্ডারিংয়ের অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে দুই মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশনা দেন।
ব্যারিস্টার মিসবাহ আরো বলেন, ব্যাংকের দুইজন আমানতকারী কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় হাইকোর্টে দায়ের করা রিট পিটিশনে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) সুরক্ষা নীতি ও গাইডলাইন, ২০১৫ এর ১.২ ও ১০.২ ধারা অনুযায়ী গাইডলাইনটির উদ্দেশ্য লঙ্ঘন করে ব্যাংকটি ও ফ্লোরা টেলিকম আমানতকারীদের এবং ব্যাংককে মারাত্মক সাইবার ঝুঁকিতে ফেলেছে। অন্যদিকে ফ্লোরা টেলিকম কর্তৃক আইন ভঙ্গ করে কোর ব্যাংকিং সেবা গ্রহণে বাজার মূল্যের চেয়ে তিনগুণ মূল্য হাতিয়ে নিলেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি ফ্লোরা টেলিকমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। রিট পিটিশনে আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার্থে এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে তদন্তপূর্বক আশু ব্যবস্থা নিতে এবং দোষী কোম্পানি ফ্লোরা টেলিকমের সাথে ওই ব্যাংককে কোন প্রকার ব্যবসা পরিচালনা না করার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। রিট পিটিশনে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে। ৩০ নভেম্বর শুনানি শেষে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া এবং বিচারপতি মহিউদ্দিন শামীমের দ্বৈত আদালত উপরোক্ত আদেশ প্রদান করেন।
অন্যদিকে, সরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতের প্রেক্ষিতে ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেডের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্তে নেমেছে। গত ১৮/১১/২০২০ইং তারিখে উপপরিচালক ঋত্বিক সাহা স্বাক্ষরিত এক পত্রে দুদকের সিস্টেম এনালিস্ট ও পরিচালককে অভিযোগ অনুসন্ধান করে বিধি মোতাবেক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য বলা হয়েছে। দুদকের তদন্ত পত্রে বলা হয়েছে, ফ্লোরা টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউক ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দরপত্রের শর্ত ভঙ্গ, জাল জালিয়াতি, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তৃতীয় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (ডিইপিপি-৩) এ নকল কম্পিউটার সরবরাহ করে ১৫০ কোটি টাকা লোপাট, অগ্রণী ব্যাংকের ২০০ কোটি টাকার কাজ নেওয়ার পাঁয়তারাসহ টেলিটকের ৬ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ফ্লোরা টেলিকম কর্তৃক হাইকোর্টে দায়েরকৃত আরবিট্রেশন পিটিশন গত ১৪/১০/২০২০ইং তারিখে স্ব উদ্যোগে প্রত্যাহারের আবেদন করলে প্রদত্ত আদেশে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকার তার পর্যবেক্ষণে ফ্লোরা টেলিকম কর্তৃক ৭২ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং বিষয়টি তদন্ত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে নির্দেশনা প্রদান করেন। পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, ফ্লোরা টেলিকম কর্তৃক ব্যাংকের অর্থ বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশে পাঠানোর বিষয়টি অগ্রণী ব্যাংকের নজরদারী করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও ব্যাংক তা পরিপালন করেনি।
এদিকে, রফিকুল ইসলাম ডিউকের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের অভিযোগ নতুন কিছু নয়। প্রথম সারির রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির সাথে জার্মান কোম্পানির চুক্তি হয় কোর ব্যাংকিং সফটওয়ার আপগ্রেডেশন, রক্ষণাবেক্ষণ ও সেবা প্রদানের জন্য। জার্মানে কোম্পানির নাম টেমিনস। ফ্লোরা টেলিকমের বিরুদ্ধে নানামুখী দুর্নীতি এবং শর্তভঙ্গের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তা গণমাধ্যমে প্রকাশের পর টেমিনস চলতি বছরের ২৬ জুন রফিকুল ইসলাম ডিউকের সাথে চুক্তি বাতিল করে দেয়। টেমিনসের এশিয়া অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক মার্টিন ফ্রিক সিঙ্গাপুর অফিস থেকে সেটি বাতিল করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে আনুষ্ঠানিক চিঠির মাধ্যমে জানান। এ সংক্রান্ত চিঠি ভোরের পাতার হাতে রয়েছে। তবে, ফ্লোরা টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোস্তফা রফিকুল ইসলাম ডিউক দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তাকে কঠোর নজরদারিতে রেখেছে গোয়েন্দা সংস্থা। সূত্র জানিয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশন ইতিমধ্যেই রফিকুল ইসলাম ডিউক এবং তার প্রতিষ্ঠান ফ্লোরা টেলিকমের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও রফিকুল ইসলাম ডিউকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে। তার পাসপোর্ট ও ভিসা পর্যালোচনা করতেও নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দুদক এক্ষেত্রে বিদেশে কি পরিমাণ অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন এই ডিউক সে বিষয়ে অধিকতর খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
ডিউকের বিরুদ্ধে এসব মুদ্রাপাচারের অভিযোগ নিয়ে দুদকের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ভোরের পাতাকে বলেন, আমি মাত্র ২ দিন হয়েছে দুদকে যোগদান করেছি। এখনো বিষয়টা পুরোপুরি জানি না। তবে এখনই খবর নিচ্ছি। তবে তিনি বলেন, দুদকের সচিব হিসাবে যেকোনো দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্যই সরকার আমাকে নিয়োগ দিয়েছে। সরকারের প্রতি আস্থাশীলতার কোনো ঘাটতি হবে না। তাই যেকোনো দুর্নীতিবাজের মতো রফিকুল ইসলাম ডিউকের বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে তদন্ত শেষে।
এ বিষয়ে ডিউকের তদন্ত সংশ্লিষ্ট দুদকের আরেকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের পাতাকে বলেন, ফ্লোরা টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বর্তমানে দেশে নেই। আমরা তার অফিসে ইতোমধ্যেই যোগাযোগ করেছি। তার বিরুদ্ধে অর্থপাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের হাতে এসেছে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ ও প্রতারণার মাধ্যমে নানা দুর্নীতির তালিকাও হাতে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া এবং দুবাইয়ে তার সম্পদের খোঁজও করা হচ্ছে। খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সব তথ্য যাচাই বাছাই করে আমরা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিবো। তারপর অবশ্যই আইনগতভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিদেশ থেকেও তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের সহযোগিতা চাওয়া হবে বলেও জানান দুদকের এই কর্মকর্তা।