প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:১৯ এএম আপডেট: ২২.১২.২০২০ ৩:১৫ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
তেল-গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, দেশের পাট ও চিনিকল বন্ধ হলে জাতীয় অর্থনীতিই ক্ষতির মুখে পড়বে। তিনি অভিযোগ করেন, বিশ^ যখন পরিবেশবান্ধব শিল্প সন্ধান করছে, বাংলাদেশ তখন জবরদস্তি, প্রতারণা, মিথ্যাচার করে বিশাল সম্ভাবনাময় পাট ও চিনিশিল্প বন্ধ করে দিচ্ছে। এসব কল বন্ধ করা মানে জাতীয় ক্ষতিকে ত্বরান্বিত করা। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর রুনি মিলনায়তনে পাটকল ও চিনিকল বিষয়ে অনুসন্ধান ও গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ নিয়ে গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সর্বজনকথা।
গবেষক ড. মাহা মির্জা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোশাহিদা সুলতানা পাটকল ও চিনিকল বিষয়ে সরেজমিন অনুসন্ধানের প্রতিবেদন ও গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, পাটকল শ্রমিক আবদুল হালিম মিঠু ও চিনিকল শ্রমিক ফেরদৌস ইমাম।
ড. মাহা মির্জা বলেন, ‘দেশের প্রায় ৭৫টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান ১৯৯৩ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৩১টি প্রতিষ্ঠানই বন্ধ হয়ে গেছে। আর চালানো সম্ভব হয়নি প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি কারখানা। সস্তায় জমি, যন্ত্রপাতি লুট করা অথবা পরিত্যক্ত জমি দেখিয়ে বিপুল ব্যাংকঋণ নেওয়া হয়েছে এসব ক্ষেত্রে। বেসরকারিকরণ করা হলেই শিল্পের সম্প্রসারণ হবে, এই যুক্তির কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।’ তিনি আরো বলেন, ‘খুলনার পাটকলের সঙ্গে শুধু পাটচাষীই নয়, গোটা একটি অঞ্চলের অর্থনীতি জড়িত। শিল্প এলাকার অসংখ্য মুদির দোকান, ভাতের হোটেল, আসবাবের দোকান, কাপড়ের দোকানসহ নানা ধরনের অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পাটকল বন্ধের ফলে আজকে হুমকির মুখে। শুধু পঞ্চাশ হাজার পাট শ্রমিকের চাকরি চলে যাওয়া পাটকল বন্ধ হওয়ার মানে নয়, বরং একটা গোটা অঞ্চলের স্থানীয় অর্থনীতি ধ্বংসের মুখে পড়া।’
অধ্যাপক মোশাহিদা সুলতানা বলেন, ‘মাড়াই করার জন্য যে আখ পাওয়া যায় তা থেকে চিনি আহরণ হয় মাত্র ৬ থেকে ৭ শতাংশ। অথচ ১২ থেকে ১৪ শতাংশ হারে ভারতে এবং ব্রাজিলে চিনি আহরণ করা হয়। ভারত বা ব্রাজিল যেখানে ১০০ কেজি আখ থেকে ১২ থেকে ১৪ কেজি চিনি উৎপাদন করে সেখানে বাংলাদেশ তার প্রায় অর্ধেক। নষ্ট ও পুরাতন যন্ত্র ব্যবহারের কারণে চিনি কম আহরিত হচ্ছে শুধু তাই নয়, প্রতি কেজি চিনি উৎপাদনে বাড়তি খরচ যোগ হচ্ছে। বিদ্যুতের ব্যবহার, রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, সময়ের অপচয় ইত্যাদিও অনেক বেশি হচ্ছে।’
অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খান বলেন, ‘শুধু আর্থিক হিসাব দিয়ে মিলগুলোর লোকসান বিবেচনা করা হয়। অথচ স্থানীয় পর্যায়ের রাষ্ট্রায়ত্ত মিলের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অবদানগুলোকে স্বীকার করা হয় না। শ্রমিক পরিবারগুলোর জন্যে শিক্ষা, চিকিৎসা, এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল এবং চিনিকলগুলো। অথচ গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিক ও তাদের পরিবারের ক্ষেত্রে আমরা উল্টো চিত্র দেখি।’
ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়–য়া বলেন, ‘শ্রম আইনের ৩২ ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ করা আছে যে, পাওনা পরিশোধ না করে কোনোভাবেই শ্রমিককে তার বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না। অথচ আমরা দেখছি সরকার নিজেই শ্রম আইন লঙ্ঘন করছে। বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা শ্রমিককে নিরাপত্তা দেয় না, আইনে যতটুকু সুরক্ষার আয়োজন আছে, সেটাকেও সরকার মানে না। যদি চিনিকল বন্ধই করতে হয়, তাহলে রংপুর চিনিকলে ২০১৬ সালে যে তিন জনকে খুন করে আড়াই হাজার মানুষের ঘরবাড়ি পোড়ালেন কেন? রাষ্ট্রকে জবাবদিহি করতে হবে।’
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ তার বক্তব্যে আরও বলেন, ‘রাষ্ট্র ব্যবসা করবে তা নয়, কিন্তু কৌশলগত শিল্প হিসেবে পাটশিল্প বিকাশে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করতে হবে। রাষ্ট্র ব্যবসা করবে না বলা হচ্ছে একদিকে অন্যদিকে ভারত, রাশিয়া, চীন, জাপান, নরওয়ের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশাল ব্যবসার পথ করে দিতে দেশকে মহাবিপর্য়ের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। পাটশিল্প লোকসানের দায় মন্ত্রী কেন নেবেন না? গামের্ন্টস মালিক, রেন্টাল বিদ্যুৎ মালিকদের প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হয় অথচ এক হাজার কোটি টাকা দিলে পাটশিল্প ঘুরে দাঁড়াতে পারত।’ পাটকল ও চিনিকলে অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িতদের বিচার, শিল্পের আধুনিকায়ন, বিতরণ ও বিপণন ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনার মাধ্যমে এই দুই শিল্পকে লাভজনক করা সম্ভব বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়। সেই সঙ্গে চিনিকলের নিজস্ব জমিতে রিফাইনারি স্থাপন করে সারা বছর রিফাইন সুগার উৎপাদন করে চিনিকলগুলোর লোকসান কমিয়ে বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ শক্ত করার দাবি জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মাঝে উপস্থিত ছিলেন, সিপিবির রুহিন হোসেন প্রিন্স, বাসদের রাজেকুজ্জামান রতন, গণসংহতি আন্দোলনের জুলহাসনাইন বাবু, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের ফয়জুল হাকিম লালা, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির শহীদুল ইসলাম সবুজ প্রমুখ।