প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৫৮ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সাল। ঘটনাস্থল জগৎমল্লপাড়া, রাউজান, চট্টগ্রাম। এদিন সকালে গোলাগুলির আওয়াজ শুনে অনেক সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন জগৎমল্লপাড়া ছেড়ে চলে যায়। একজন প্রত্যক্ষদর্শী দ্বিজয় চন্দ্র কৃষ্ণ সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, ১৩ এপ্রিল সকাল নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার দিকে বাড়ির পশ্চিম দিক থেকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। গোলাগুলির শব্দ শুনে আমার বাবা-মা, ভাই ও বৌদিসহ আমরা ডাবুয়ায় আমার মাসির বাড়ির উদ্দেশে রওনা হই। কিন্তু জগৎমল্লপাড়ার অধিকাংশ লোক নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেনি। তারা ভেবেছিল নিরীহ এই গ্রামবাসীর উপর কেনই বা পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালাবে। অন্যদিকে স্থানীয় রাজাকার মাবুদ, গোলাম আলী, নওয়াব মিয়া, মোহাম্মদ বখশসহ অন্যান্যরা গ্রামবাসীকে অভয় দেন। তাদের কোনো ক্ষতি করা হবে না। কিন্তু কুন্ডেশ্বরীতে নূতন চন্দ্র সিংহকে হত্যার পর ঘাতকের দল আসে জগৎমল্লপাড়ায়। নন্টু মেম্বারের উঠানে দাঁড়িয়ে তারা মিটিংয়ের কথা বলে। কেউ মিটিংয়ের কথা শুনে স্বেচ্ছায়, কাউকে বা জোর করে নিয়ে আসা হয়।
। সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলছিলেন, ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে সকাল সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী স্থানীয় সহযোগীদেরসহ পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে হিন্দু অধ্যুষিত জগৎমল্লপাড়ায় সশস্ত্র অভিযান চালায়। এসময় সাকা চৌধুরীর দুজন সহযোগী আব্দুল মাবুদ ও অপর একজন জগৎমল্লপাড়ায় সেখানকার হিন্দু নর-নারীদের সবাইকে কথিত এক মিটিংয়ে অংশগ্রহণের আহ্বান জানান। তাদের কথায় বিশ্বাস করে এলাকাবাসী কিরণ বিকাশ চৌধুরীর বাড়ির আঙ্গিনায় একে একে জড়ো হতে থাকে সবাই। তাদেরকে একত্র করে বসানো হয়। অতঃপর সাকা চৌধুরীর উপস্থিতিতে তাদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। গুলিতে মারা যান ৩২ জন। যাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে ছিলেন তেজেন্দ্র লাল নন্দী, সমির চৌধুরী, অশোক চৌধুরী, সীতাংশু বিমল চৌধুরী, প্রেমাংশু বিমল চৌধুরী, কিরণ বিকাশ চৌধুরী, সুরেন্দ্র বিজয় চৌধুরী, প্রভাতী চৌধুরী, রাজলক্ষ্মী চৌধুরাণী, কুসুম বালা চৌধুরাণী, যতীন্দ্র লাল সরকার, হীরেন্দ্র লাল সরকার, প্রভাতী সরকার, দেবেন্দ্র লাল চৌধুরী, রাজেন্দ্র লাল চৌধুরী, অজিত কুমার চৌধুরী, পরিতোষ চৌধুরী, ভবতোষ চৌধুরী, গোপাল চৌধুরী, রানী বালা চৌধুরাণী, মঞ্জুর চৌধুরী, ঝিনু চৌধুরী, দেবু চৌধুরী, স্বপন চৌধুরী, ফণীভূষণ চৌধুরী, মধুসূদন চৌধুরী, বিপিন চৌধুরী সহ আরও অনেকে।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বীরযোদ্ধা মাস্টার দা সূর্য সেনসহ অসংখ্য বিপ্লবী ও বিদ্রোহীর জন্মস্থান চট্টগ্রামের রাউজান। এখানেই জন্মেছিলেন মধ্যযুগের কবি দৌলত কাজী। অমর একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ কবিতার রচয়িতা মাহবুব উল আলম চৌধুরীও জন্মেছিলেন এ এলাকায়। একাত্তরের ঘাতক তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী এ এলাকায় বেশ কয়েকটি বড় গণহত্যা সংঘটনকারী ব্যক্তি। প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ ও আয়ুর্বেদ প্রতিষ্ঠান কু-েশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা নূতন চন্দ্র সিংহ হত্যাসহ পাকসেনাদের সহায়তায় বিভিন্ন গণহত্যায় সাকা চৌধুরী নিজে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দেন বলে স্থানীয়রা সাক্ষ্য দিয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধ বিচার মামলায় একাত্তরে গণহত্যা সংঘটনের দায়ে ২০১৫ সালের ২২ নভেম্বর তার ফাঁসি কার্যকর হয়।
জগৎমল্লপাড়া গণহত্যা নিয়ে ১৯৭১ :গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর ট্রাস্ট কর্তৃক প্রকাশিত গণহত্যা নির্ঘন্ট গ্রন্থমালায় জগৎমল্লপাড়া গণহত্যা নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এ গবেষণাগ্রন্থটি লিখেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সরকারী অধ্যাপক ডক্টর চৌধুরী শহিদ কাদের।