নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী কয়েক ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে পৌর নির্বাচন। এর মধ্যে তিন দফায় ঘোষিত তফসিলে ১৫০ পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে চলতি ডিসেম্বর ও আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ২৫ পৌরসভার নির্বাচন ২৮ ডিসেম্বর, দ্বিতীয় ধাপে ৬১ পৌরসভায় নির্বাচন ১২ জানুয়ারি এবং তৃতীয় ধাপের ৬৪টি পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩০ জানুয়ারি। তৃণমূলের এ নির্বাচনকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। গতকাল শুক্রবার তারা দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠেয় ৫৫টি পৌরসভা নির্বাচনের মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করেছে। দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এর আগে গত ৩ নভেম্বর প্রথম ধাপের পৌরনির্বাচনের মেয়র পদে ২৩ জনকে দলীয় মনোনয়ন দেয় বিএনপি। অপরদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ গত ২৮ নভেম্বর প্রথম দফার পৌর ভোটের ২৫ মেয়র প্রার্থীর মনোনয়ন আগেভাগেই চূড়ান্ত করে। গতকাল দ্বিতীয় দফার মেয়র মনোনয়নও চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠেয় তৃণমূল পর্যায়ের এ নির্বাচনে যথারীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যেই মূল লড়াই অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। কারণ জাতীয় নির্বাচনের আদলে দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন চালু হওয়ার পর থেকে তৃণমূলের নির্বাচনও জাতীয় ভিত্তিক দলগুলোর কাছে মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। সে হিসেবে টানা তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের কাছে নিজেদের জনপ্রিয়তার অক্ষুণœতা প্রমাণ করা যেমন চ্যালেঞ্জের তেমনি দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকায় হতাশ নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা এবং নিজেদের হৃত শক্তি উদ্ধার করাও বিএনপির মতো দলের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করা হচ্ছে। তবে ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা প্রশাসনিক যে সুবিধা প্রচ্ছন্নভাবে পায় বিএনপি স্বভাবতই সে সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে- এমনটাও মনে করছেন কেউ কেউ। আবার অনেকে মনে করছেন, এটি একেবারেই ভুল। রাজনৈতিক দলেগুলোর শক্তি নির্ভর করে তার সাংগঠনিক সক্ষমতার ওপর। তাছাড়া কে কতটা জনসম্পৃক্ত রয়েছে তাও রাজনৈতিক দলগুলোর জনসমর্থনের ক্ষেত্রে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা আন্দোলনের মাঠ দখলে রেখেছেন। আসন্ন পৌর নির্বাচনের আগে এ ধরনের একটি আন্দোলন দলটিকে নির্বাচনে বাড়তি সুবিধা এনে দিয়েছে। নির্বাচনের আগেই মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা অনেকটা ওয়ার্মআপ করে নিয়েছে। সেই সঙ্গে ভাস্কর্য ইস্যুতে বক্তৃতা-বিবৃতি সবই বিএনপি-জামায়াত ও তাদের সমর্থিত রাজনৈতিক গোষ্ঠীর বিপক্ষেই যাচ্ছে। এতে জনগণের কাছে বিএনপি-জামায়াত বা ২০ দলীয় জোটের প্রার্থীদের ইমেজ কিছুটা আঘাতগ্রস্ত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্প্রতি ভাস্কর্য ইস্যুতে হেফাজতসহ অন্যান্য ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলের উগ্র আচরণ, বক্তব্য প্রদান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের প্রচ্ছন্ন সমর্থন ও মদদ রয়েছে বলে চাউর হয়েছে সবখানে। কারণ হেফাজতে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ও বক্তা বিএনপি-জামায়াতের মতাদর্শকে ধারণ ও লালন করে বলে মনে করা হয়। এছাড়া এদের শীর্ষনেতাদের অনেকেই সরাসরি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের নানা দলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। ফলে ভাস্কর্য ইস্যুতে সংঘঠিত গোটা আন্দোলনের সুবিধাভোগী হবেন আওয়ামী লীগ। এবং তার দৃশ্যমান প্রভাব গিয়ে পড়বে পৌর নির্বাচনে।
অন্য সময় শীতের মওসুমে বিভিন্ন স্থানে ধর্মীয় সভার নামে ওয়াজ মাহফিলে লাগামহীন রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে বেড়াতো বিভিন্ন ধর্মীয় বক্তা। ওইসব ওয়াজে আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল শক্তি তো বটেই ভিন্ন ধর্মাবলম্বী, চিন্তাবলম্বী মানুষ ও গোষ্ঠীর ব্যপারে বিদ্বেষ ও বিষোদগার ছড়ানো হতো। কিন্তু গত কয়েক মাসে উসকাসীমূলক বক্তব্য, মিথ্যা তথ্য দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা এবং ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়ানোর অভিযোগে কয়েকজন বিতর্কিত বক্তার ওয়াজে লিখিত ও অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। অনেক স্থানে এসব বিতর্কিত বক্তার ওয়াজ বন্ধ করে দিচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফলে এবার বিতর্কিত ইসলামী বক্তাদেও দৌরাত্ম্য যেমন কিছুটা কমেছে তেমনি আওয়ামী লীগ বা প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত বিদ্বেষ ছড়ানোও কিছুটা বন্ধ হয়েছে। এর ইতিবাচক প্রভাব যথারীতি পৌর নির্বাচনে পড়তে পারে বলেও মনে করছেন অনেকে।
হেফাজতসহ অন্যান্য ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সৃষ্ট অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সামাল দিতে বিশেষ করে কোন রকম বিশৃঙ্খলা যাতে কেউ সৃষ্টি করতে না পারে সেজন্য দলের তৃণমূলকে নির্দেশ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। ধর্মীয় সভা ও ওয়াজ মাহফিলে কোন রকম বিভ্রান্তকর ও উস্কানীমূলক তথ্য যাতে কেউ দিতে না পারে সে জন্য সবাইকে সজাগ করছেন দলের তৃণমূলের নেতারা। তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে সবাই সাবধান করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাতে কেউ এই ইস্যুতে কোন রকম উস্কানীমূলক তথ্য তৈরি করতে না পারে তার জন্য কাজ করছে আওয়ামী লীগ। পাশাপাশি তারা পৌর নির্বাচনে দলের যোগ্য প্রার্থী দিয়ে মাঠে থাকার জন্য নির্দেশ দিয়ে মনিটরিং করা হচ্ছে কেন্দ্র থেকে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাছাইয়ের লক্ষে ইতোমধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। আর এরইমধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের জন্য তারা প্রার্থী নাম চূড়ান্ত ঘোষণা করেছে। অন্যদিকে প্রধান বিরোধী শক্তি বিএনপিও তাদের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। তবে তাদের অভিযোগ তাদের নেতাকর্মীদের কেউ এলাকায় কাজ করতে পারছেন না। এ অবস্থায় বিএনপির তৃণমূলের পৌর নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীরা অনেকটা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নÑএমনটাই মনে করেন নির্বাচন বিশ্লেষকরা। বিএনপি পৌরসভা নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিলেও মাঠে না থাকতে পারা অভিযোগ রয়েছে তাদের তৃলমূলের নেতাদের বিরুদ্ধেও। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, পৃথিবীর সব দেশেই স্থানীয় সরকারে রাজনীতির একটি প্রভাব রয়েছে। যদি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হয়, তবে সরকারের জনপ্রিয়তার বিষয়টি নির্বাচনের মাধ্যমে উঠে আসবে। তিনি বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের এলাকায় থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। হামলা মামলা করে তাদের এলাকা ছাড়া করা হচ্ছে।
নির্বাচনের সব প্রস্তুতি এগিয়ে রাখছে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তারা বলছে, তিন শতাধিক পৌরসভার মধ্যে আরও প্রায় ১৭০ পৌরসভা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন উপযোগী রয়েছে। গত ১৩ ডিসেম্বর রোববারের কমিশন সভায় সার্বিক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্তের বিষয়ে ইসি সচিব আলমগীর বলেন, ‘আর তিনটি ধাপে ১৬৯ পৌরসভায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের ভোট মধ্য জানুয়ারি, তৃতীয়ধাপের ভোট জানুয়ারির শেষের দিকে। আর চতুর্থ ধাপের ভোট হবে মধ্য ফেব্রুয়ারিতে।’ এ লক্ষ্যে দ্বিতীয় ধাপের পৌরসভাগুলোর ভোটের তফসিলও দেওয়া হয়েছে। সক্ষমতা, প্রাপ্তি, প্রশিক্ষিত লোকবল ও কারিগরি বিষয় বিবেচনায় সব পৌরসভায় ইভিএমে ভোট করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান সচিব।
পৌর নির্বাচনের সমন্বয়ক ইসির উপসচিব মিজানুর রহমান জানান, বাছাই শেষে প্রথম ধাপের ২৫ পৌরসভায় যাচাই-বাছাই শেষে মেয়র পদে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা ১০৩; সাধারণ ওয়ার্ডে বৈধ প্রার্থী ৮৯১ জনে দাঁড়িয়েছে। আর সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ২৭৮ জন প্রার্থী রয়েছেন। তিন পদে মোট মনোনয়নপত্র বৈধ হয়েছে ১ হাজার ২৭২ জনের। দ্বিতীয় ধাপে ৬১ পৌরসভায় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে কমিশন। তফসিল অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপের ৬১টি পৌরসভায় মনোনয়ন দাখিলের শেষ সময় আজ শনিবার, মনোনয়ন বাছাই ২২ ডিসেম্বর, প্রত্যাহার ২৯ ডিসেম্বর এবং ভোট হবে ১৬ জানুয়ারি। এ ধাপে ৬১টি পৌরসভার মধ্যে ২৯টিতে ইভিএম এবং ৩২টিতে ব্যালটের মাধ্যমে ভোট হবে। নির্বাচন উপযোগী পৌরসভায় চার ধাপে ভোট হবে এবার। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিরতিহীনভাবে ভোট হবে।
তৃতীয় ধাপে ৬৪টিতে ভোট হবে আগামী ৩০ জানুয়ারি। গত ১৪ ডিসেম্বর নির্বাচন কমিশন এসব পৌরসভার ভোটের তারিখ ঘোষণা করে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় ৩১ ডিসেম্বর, বাছাই ৩ জানুয়ারি, প্রত্যাহারের শেষ সময় ১০ জানুয়ারি। ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব মো. আলমগীর বলেন, কমিশনের অনুমোদনের পর সোমবার এই তফসিল দেওয়া হয়েছে। ৬৪টি পৌরসভার সবগুলোতেই ব্যালট পেপারে হবে ভোট হবে। করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে এবার চার ধাপে পৌর নির্বাচন হবে। তার মধ্যে তিন ধাপে ১৫০টি পৌরসভার তফসিল হল। এর আগে প্রথম ধাপের তফসিলের ২৫টি পৌরসভায় ইভিএমে ভোট হবে ২৮ ডিসেম্বর। ১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপের ৬১ পৌরসভায় ভোট হবে। এর মধ্যে ২৯টি পৌরসভায় ইভিএম এবং ৩২ পৌরসভায় ব্যালটে ভোটগ্রহণ হবে। আর তৃতীয় ধাপে ৬৪টি পৌরসভায় ৩০ জানুয়ারি ভোটের তারিখ রেখে সোমবার তফসিল দেওয়া হয়েছে। বাকি যেসব পৌরসভা ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন উপযোগী হচ্ছে, সেসব এলাকায় চতুর্থ ধাপের ভোট হবে। দেশে মোট পৌরসভা রয়েছে ৩২৯টি। আইন অনুযায়ী, মেয়াদ শেষের আগের ৯০ দিনের মধ্যে স্থানীয় সরকারের এ প্রতিষ্ঠানে ভোট করতে হয়। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী পৌরসভার নির্বাচন নির্দলীয় ভিত্তিতেই অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো থেকে পৌরসভা নির্বাচনের প্রার্থীদের পক্ষে সমর্থন জানানোর রীতি বেশ পুরানো। স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের পর ২০১৫ সালে প্রথম দলীয় প্রতীকে ভোট হয় পৌরসভায়। সেবার ২০টি দল ভোটে অংশ নেয়।