লক্ষ্মীপুর গণহত্যা, পাবনা
জুমার নামাজের পর ২৯ জনকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকসেনারা
আরিফ রহমান
প্রকাশ: শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:৩৮ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলে গণহত্যা চালায় বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। যে অঞ্চলগুলোতে পাকিস্তানিরা ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম একটি জেলা পাবনা। আজ আমরা পাবনার প্রত্যন্ত অঞ্চলে সংঘটিত একটি গণহত্যা সম্পর্কে জানবো। এখানে হত্যা করা হয়েছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের। পাবনা জেলার আটঘরিয়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামটি ছিল হিন্দু অধ্যুষিত। এই গ্রামটি একাত্তর সালে বলতে গেলে একেবারে অজপাড়াগাঁ ছিল। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না থাকায় একে পাবনা বা আটঘরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন জনপদই বলা হতো। এদিকে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত হওয়ার কারণে সম্ভবত এই গ্রামটির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের চোখ অনেক আগ থেকেই ছিল বলে অনুমান করা যায়।
এখানে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট। সে দিনটা ছিল শুক্রবার। সকাল ৭-৮টায় পাকিস্তানি বাহিনী আতাইকুলা সড়াডাঙি মাদরাসার রাজাকার মাওলানা নবাব আলীকে সঙ্গে নিয়ে একটি বড় নৌকাযোগে বাগচীপাড়ায় অবস্থিত পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে ইছামতী নদী দিয়ে লক্ষ্মীপুরের হিন্দুপাড়ায় আসে। দলে ছিল ২০-২৫ জন পাকিস্তানি সেনা এবং ৫-৭ জন রাজাকার। পাকিস্তানি সেনারা প্রথমেই পুরো হিন্দুপাড়া চারদিক থেকে ঘেরাও করে ফেলে। একেবারে শুরুতেই স্থানীয় নিজাম উদ্দিন শেখ এবং বাজি শেখকে ধরে নিয়ে আসে। নিজাম উদ্দিন ও বাজি শেখকে বেদম মারপিট করে তাদের সঙ্গে করে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা ৩-৪ ঘণ্টা গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি করে। তারা খোঁজ করছিল মুক্তিবাহিনীর সদস্য আর হিন্দুদের। বাড়ি বাড়ি খুঁজে হিন্দু পুরুষদের ধরতে থাকে পাকিস্তানি হানাদাররা। শেষে নিজাম উদ্দিন ও বাজি শেখসহ ২৭ জন হিন্দু এবং ৩ জন মুসলমানকে বেঁধে কালীমন্দিরের সামনে এনে লাইনে দাঁড় করানো হয়। নিজাম উদ্দিন কাকুতি-মিনতি করলেও তাকে ছাড়েনি। তবে বাজি শেখ একজন পাকিস্তানি সেনাকে অনুনয়-বিনয় করে কালীবাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালাতে সক্ষম হন।
জুমার নামাজ শেষে এই ২৯ জনকে একসঙ্গে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে রক্তের বন্যা বয়ে গেলো লক্ষ্মীপুর গ্রাম। ২৮ জন ঘটনাস্থলেই শাহাদাতবরণ করেন। একজন আহত হলেন। তার নাম ছিল ভবানী শীল। স্থানীয়ভাবে তিনি আদুলী নাপিত হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হত্যাযজ্ঞ শেষে পাকিস্তানি সেনারা কয়েকটি বাড়িতে ঢুকে হিন্দু নারীদের নিপীড়ন করে। নারীদের কেউ কেউ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। ভুক্তভোগীরা জানান, বেশির ভাগ ধর্ষণ রাজাকাররাই করেছিলেন। ধর্ষণের শিকার হওয়া অনেক নারী এবং তাদের পরিবার বঞ্চনা সহ্য করতে না পেরে স্বাধীনতার পরে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা যখন হিন্দুপাড়ায় আক্রমণ করে তখন গ্রাম জনশূন্য হয়ে যায়। সবাই যার যার মতো পানের বরজ, বাঁশের ঝাড় ও পাশর্^বর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। সময়টি বর্ষাকাল হওয়ায় এবং এলাকাটি পানের বরজ এবং বাঁশঝাড়বেষ্টিত হওয়ায় অনেকেই সেদিন আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যেতে পেরেছিলেন। না হলে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারতো বলে মনে করেন অনেকেই। লক্ষ্মীপুর গ্রামের ওই গণহত্যার পর বিকেলে পাকিস্তানি সেনারা স্থানটি ত্যাগ করলে এলাকাবাসী মিলে কালীবাড়ির সামনে মাটি গর্ত করে একই গর্তে ২৬ জনকে সমাহিত করেন। গণহত্যা গবেষক যাহিদ সুবহান মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে এই গণহত্যা নিয়ে ‘লক্ষ্মীপুর গণহত্যা’ শীর্ষক গবেষণা গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে গণহত্যা-নির্যাতন ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র থেকে। কারা কীভাবে এই ঘৃণ্যতম গণহত্যা সংঘটিত করেছিল, নির্যাতিত ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষ্য থেকে সেটা তুলে আনা হয়েছে এই বইতে। এই গণহত্যা সম্পর্কে বিষদ জানতে বইটি কাজে দেবে।