বিখ্যাত নারী উদ্যোক্তা এমান্ডা কাহলো বলেছেন, নিজের এবং নিজের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সত্য থাকুন। কোনও এক ব্যক্তির মতামত আপনাকে নড়াচড়া করতে দেবেন না; শুনুন, তবে আত্মবিশ্বাসী হন। এই বিশ্বাসের উপর ভর করে, সকল পিছুটানকে পিছনে ফেলে, করোনাকে অভিশাপ মনে না করে আশির্বাদ হিসেবে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু তরুণ নারী শিক্ষার্থী ও উদ্যোক্তারা।
এরকমই কয়েকজন নারী শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হয়ে ওঠার গল্প লিপিবদ্ধ করেছেন 'ভোরের পাতার' জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি 'রেজওয়ান সীমান্ত।'
সাহসী মেয়ে 'ফাতেমা তুজ জোহরা,' পড়াশোনা করছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এর নৃবিজ্ঞান বিভাগে, সকল পিছুটান কে উপেক্ষা করে গড়ে তুলেছেন নিজস্ব রান্নাঘর(অনলাইন ভিত্তিক সুলভ মূল্যে হোমমেইড খাবারের দোকান), শুনে আসি তার গল্প, "উদ্যোক্তা শব্দ টা অনেক বড়,তাই শুরু করেই নিজেকে উদ্যোক্তা বলে পরিচয় দিতে ভয় হয়।তবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি যাতে নিজেকে উদ্যোক্তা হিসাবে পরিচয় দিতে পারি। অনেক ছোট বয়স থেকেই আমার রান্না করতে খুব ভালো লাগে। শখের রান্না, নতুন রান্না সবসময় করার প্রতি খুব ঝোক ছিলো। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর প্রথম ৬ মাস সাভার থেকে যাওয়া আসা করি। তাই ইউনিভার্সিটি বাসে যাওয়া আসা করতাম আর দুপুরে ক্যাম্পাসে খাওয়া দাওয়া করতাম,,তখন ভাত পাওয়া যেত না খিচুড়ি ডিম খেতে হতো। আর তাতে যে পরিমাণ হলুদ,মরিচ দেওয়া হতো দু দিন খেলেই পেটে সমস্যা হতো। সেই জায়গা থেকেই মনে হয় যদি কখনো সুযোগ হয় আমি হোম মেড ফুড নিয়ে কাজ করবো।যাতে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক যারা দূর থেকে আসে তারা যেন দুপুরের খাবারটা স্বাস্থ্যসম্মত এবং সাশ্রয়ী ভাবে খেতে পারে।এই দুইটা কারণেই মুলত এই উদ্যোগ নেওয়া। আপাতত অনলাইন বেজ,পরে দেখা যাবে,একদিন "সুগন্ধি রসুইঘর " এর সুবাস সারা দেশে ছড়িয়ে পরবে ইনশাআল্লাহ ।খাবার নিয়ে কাজ করা তাও আবার মেয়ে মানুষ!!! এটা অনেক বড় বাঁধা, সবার একটাই প্রশ্ন চাকরির চেষ্টা না করে এসব করলে ভবিষ্যতে কি হবে, এর কি কোন ভবিষ্যৎ আছে? আমি বলবো আছে, আফরোজা খানম যদি পুরো দক্ষিণ এশিয়াতে সব থেকে বড় ক্যাটারিং সার্ভিস রান করাতে পারেন মেয়ে মানুষ হয়ে, তবে আমার চেষ্টা করতে দোষ কী? এটাতে কিছু মানুষের পিছুটান থাকলেও আমার মা, ছোট ভাই, বন্ধু-বান্ধবী আর কাছের কিছু ভাই বোন, বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষিকা, রুমমেট এই মানুষ গুলোর কাছে যে সাপোর্ট আর ভালোবাসা পেয়েছি তা আমাকে সব থেকে বেশি উৎসাহ যোগায়, সাহস দেয়। এজন্যই হয়তো টিউশন, ক্লাস সব ম্যানেজ করে সুগন্ধি রসুইঘর এ সময় দেই। যে সেক্টরই যাই লড়াই করেই জীবনে এগিয়ে যেতে হয়,আমি না হয় হাতা খুন্তি নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেলাম। এই কাজটা শুরু করবার আগে টিউশন করালেও মনে হতো বেকার জীবন, কিন্তু এখন মনে হয় কিছু করছি। এই সাহসে এগিয়ে যেতে চাই।"
আরেক নারী উদ্যোক্তা, তামজিদা ইসলাম, মেয়ে হয়েছেন তো কি? পিছিয়ে থাকতে চান না, কাজেই বেকার হয়ে বসে না থেকে অনলাইনে শুরু করেছেন শাড়ী ও ড্রেসের ব্যবসা। তার সেই সাহসী গল্প শুনিয়েছেন আমাদের, শুনেই আসি তার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প, "আমি যখন ক্লাস ৯ এ পড়তাম উদ্যোক্তা কথাটা আমাকে খুব ভাবাতো, এর মধ্যে নিজের নিজের একটা ভাব আছে। এই করোনায় আর লকডাউনে যখন মানসিকভাবে ক্রমাগত ভেঙ্গে পরছিলাম তখন মনকে শক্ত করে ভাবলাম নতুন কিছু শুরু করতে হবে। কি করবো কি করবো ভেবে একটা অনলাইন পেইজ খুলে ফেললাম। খুলে ভাবছিলাম কি করবো এখন, কিছু জমানো টাকা ছিল ব্যাংকে তাই নিয়ে শুরু করলাম। স্বল্প পুঁজি, তবুও কিছু একটা হবে এই আশায়। একজন ফ্রেন্ড আমাকে এই ব্যপারে অনেক পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করত।। একটু একটু করে ই শুরু করেছি আমার Gorgeous xone এর কাজ। মাত্র কয়েকদিন হলেও কিছু ক্ষেত্রে খুব ভালো সাড়া পেয়েছি। তবুও পাছে লোকে কিছু বলে একটা কথাতো থেকেই যায়,কয়েকজন বললো এটা কি কাজ, এতে কি সম্মান বাড়ে? শুনে খারাপ লাগলেও পরে ভাবলাম এমন তো কত মানুষই বলবে। কিন্তু নিজের মধ্যে একটা জেদ আসলো ওদের কথা ভুল প্রমাণ করার। নিজেকে বেকার তো আর বলবে না কেউ। আশা করি আরো সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবো। সবাই আমার জন্য দোয়া করবেন যেন এই GorgeouS Xone কে আরো বড় করে তুলতে পাড়ি।। এই সাহসে যেন এগিয়ে যেতে পারি।"
'তাহমিনা রহমান তানজিন', জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের শিক্ষার্থী, এই তরুণ নারী উদ্যোক্তাকে নতুন উদ্যমে কাজ করতে শিখিয়েছে মহামারী করোনা, চলুন শুনে আসি সেই উদ্যম, স্পৃহা ও প্রেরণার গল্প। "কথা বলছি আমার স্বপ্নপূরনের জায়গা আমার অস্বতিত্ব গড়ে তোলার জায়গা "দ্যা এক্সপ্রেসরি বাই তানজিন" নিয়ে। শুরু টা মুলত ২০১৮ সালের শেষ দিকে শীত বস্ত্র নিয়ে করলেও চলতি বছর করোনা কালীন সময় সকল টিউশন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবার নতুন উদ্যম স্পৃহা নিয়ে কাজ করার প্রেরণা জুগিয়েছে। প্রথম প্রথম কাজ সম্পর্কে ধারণা কম থাকায় অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে তবে হাল ছেড়ে না দিয়ে লেগে থাকায় কিছুটা হলেও সফলতার সাথে আমার ক্ষুদ্র ব্যবসায় পরিচালনা করতে সক্ষম হয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ, বর্তমানে কুর্তি, এক্সেসরিজ, গহনা এবং শীত বস্ত্র নিয়ে কাজ করছি । আর আমি মনে করি করোনাকালীন সময় আমার জন্য অভিশাপ নয় বরং আশীর্বাদ হিসেবে কাজ করেছে। এছাড়াও আমার পরিবারের আমার এবং আমার কাজের প্রতি আস্থা আমার মেরুদণ্ডের মত কাজ করেছে যার ফলে কাজ করার পথে যত সমস্যার সম্মুখীনই হতে হয়েছে আমার পরিবার সর্বোচ্চ সহায়তা প্রদান করেছে, আমি ভাগ্যবতী বটেই! আমার মনে হয় প্রতিটি উদ্যোক্তা তথা নারী উদ্যোক্তাদের চলার পথে পরিবারের সমর্থন খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর আমি প্রতিটি পরিবারের কাছে অনুরোধ করতে চাই আপনার মেয়েকে চলার পথে সহায়তা করুন তার পথ রোধ না করে। দিনশেষে কারো উপর যেন অর্থনৈতিকভাবে মুখাপেক্ষী না হতে হয় বরং আপন মানুষের দুঃসময়ে যেন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারি এ মূলমন্ত্র নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।"