ফরেস্টঘাট ও কাস্টমঘাট গণহত্যা, খুলনা
পাকসেনারা কাউকে ধরে নিয়ে গেলে স্বজনরা নদীর পাড়ে অপেক্ষা করতো লাশের জন্য
আরিফ রহমান
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ৫:২৮ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
ধারণা করা হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুলনার ফরেস্টঘাটে প্রতিদিন গড়ে বিশজন মানুষকে হত্যা করতো পাকসেনারা। ফরেস্টঘাট ছিল তৎকালীন স্থানীয় জজ সাহেবের বাংলোর ঠিক পেছনে। প্রতিদিন রাতে নিরীহ বাঙালিদের ভয়াবহ আর্তনাদ তিনি সহ্য করতে না পেরে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকে অনুরোধ করেছিলেন, এ ধরনের কাজ এখানে না করার জন্য। তার উত্তরে তিনি পেয়েছিলেন শাসানি। এই নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে ১৯৭১ সালের ৩০ মে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। এখানকার নির্যাতন থেকে মুক্তি পাওয়া একজন শহীদ সোহরাওয়ার্দী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক এফ এম মাকসুদুর রহমান। তিনি বলেন, তাকে যেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয় সেদিন ৪১ জনকে দড়ি দিয়ে বেঁধে জবাই করার জন্য সিরিয়াল করা হয়। তিনি ছিলেন ওই সিরিয়ালের ৬ নম্বরে। তার সামনে পর পর পাঁচ জনকে জবাই করা হয়। তিনি ছিলেন শক্তিশালী কুস্তিগীর। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তিনি কসাইকে জাপটে ধরে নদীতে ঝাঁপ দেন। ধস্তাধস্তি করে ছাড়া পেয়ে নদী দিয়ে ভেসে চলে যান নাগালের বাইরে। কিন্তু সেদিন বাকি কেউ বাঁচতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায় পুরোটা সময়জুড়ে এখানে চলে নির্মম গণহত্যা। প্রতিদিন ভাটিতে লাশের সংখ্যা দেখে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় এখানে কয়েক হাজার লোককে জবাই বা বিভিন্ন কায়দায় হত্যা করা হয়। দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি লিখেছে- ‘রাতের বেলা জজ কোর্টের পেছনে ফরেস্ট ঘাটে বাঙালিদের এনে জবাই করা হতো এবং দেহগুলো পেট চিরে নদীতে ফেলে দেওয়া হতো। এই ঘাটটি আবার জজ সাহেবের বাসার ঠিক পেছনেই। রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে সেই সব মৃত্যুপথযাত্রী বাঙালিদের করুণ আর্তনাদ জজ সাহেবের কানে পৌঁছাতো। ঘুম হতো না তার। ওই সময় গড়ে অন্তত ২০ জনকে প্রতিরাতে এখানে জবাই করা হতো বলে ধারণা। নদীতে যেভাবে মৃতদেহ ভাসতো, তাতে তাই প্রমাণ করে। তবে পেট চিরে দেওয়ার কারণে অনেক লাশ আবার নদীতে তলিয়ে যেতো। দিনে হেলিপোর্ট আর রাতে ফরেস্ট ঘাটের এইসব হত্যাকা- সহ্য করতে না পেরে জজ সাহেব তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারকে অনুরোধ করেছিলেন যে, বিচালয়ের সামনে বা পাশে যেন এ ধরণের কাজ না করা হয়। তার উত্তরে তিনি পেয়েছিলেন মৃত্যুর হুমকি। এই নৃশংসতা সহ্য করতে না পেরে কিছুদিন পরে ৩০ মে তিনি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি। এ ঘটনার একদিন পরে একইভাবে মারা যায় তার কর্মচারী সৈয়দ কায়ছার আলী এবং তার কয়েকদিন পরে মারা যায় তার পিয়ন আব্দুর রউফ।’
ফরেস্টঘাটের কাছাকাছিই ছিল কাস্টমঘাট গণহত্যা। ভৈরব নদীর পূর্ব তীরে সার্কিট হাউসের সন্নিকটে অবস্থিত কাস্টমঘাট। ফরেস্ট ঘাটের ন্যায় এ ঘাটটিকেও ঘাতকরা তাদের জল্লাদখানা হিসেবে বেছে নেয়। বিহারীদের একটি দল সার্কিট হাউসে পাকসেনাদের সাথে সবসময়ই অবস্থান করতো এবং এরাই কাস্টম ঘাটে বাঙালিদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করতো। এখানে ঘাতকরা যাদেরকে ধরে আনতো তাদেরকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় নদীতে জীবন্ত ফেলে দিয়ে হত্যা করতো। এমনই একটা হত্যা প্রচেষ্টার হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যায় খুলনা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মচারী শক্তিপদ সেন। শক্তিপদ সেন বেঁচে যাওয়ায় এ ঘটনা স¤পর্কে জানা সম্ভব হয়েছে। এভাবে এ ঘাটে তথা এ নদীতে ডুবিয়ে কতজন নিরীহ বাঙালিকে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করেছে তার পরিসংখ্যান উদ্ধার করা সম্ভব নয়।
১৯৭১ সালের পুরো স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালীন খুলনা জুড়ে চলে এই ভয়াবহ হত্যাকা-। ভৈরব নদীর যেই পাশে কাস্টমঘাটের অবস্থান তার বিপরীত পাশে ধৃত বাঙালিদের স্বজনরা অপেক্ষা করে বসে থাকতো যদি লাশ পাওয়া যায়। এভাবেই ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী নির্মম নিষ্ঠুরতায় মানুষদের হত্যা করতো। এসব ইতিহাস এ প্রজন্মের অজানা রয়ে গেছে। এসব ইতিহাস জানা আজ আমাদের কর্তব্য।