পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে এক সঙ্গে কাজ করে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লি থেকে এক ভার্চুয়াল বৈঠকে মিলিত হয়ে এই প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বৈঠকে বাণিজ্য, জ্বালানি, কৃষি, পরিবেশসহ বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার সাতটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। এসময় উভয় দেশের অর্থনীতিকে আরও উচ্চ স্থানে নেওয়ার গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, প্রাপ্ত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতকে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ভ্যালু-চেইন আরও সমৃদ্ধ করতে পারে। প্রতিবেশী দেশ দু’টির মধ্যে প্রচলিত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে এই বিষয়ে অনুঘটক হিসাবে বর্ণনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি বড় উদাহরণ হলো চিলাহাটি-হলদিবাড়ি রেল যোগাযোগ পুনরায় চালু করা যা আমরা আজ উদ্বোধন করব।’
বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের প্রতিনিধিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে। অন্যদিকে, ভারতীয় প্রতিনিধি দলের প্রতিনিধিত্ব করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নয়াদিল্লি থেকে। বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান পারস্পরিক নির্ভরতাকে আনন্দের সঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বেশ কিছুসংখ্যক ভারতীয় নাগরিক বাংলাদেশের উৎপাদন ও সেবাখাতে নিযুক্ত রয়েছেন এবং তারা নিজ দেশ ভারতে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন। অন্যদিকে, বাংলাদেশ থেকে সর্বোচ্চ সংখ্যক পর্যটক এবং চিকিৎসা সেবা গ্রহণকারীকে ভারত গিয়ে থাকেন বছরজুড়ে।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে বাংলাদেশ ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করতে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এবং ভারত কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠারও ৫০তম বছরে পা রেখেছে। আমরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। মাত্র কয়েক মাস আগে, আপনাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর সার্ধশততম জন্মবার্ষিকী আমরা উদযাপন শেষ করেছি।’ প্রধানমন্ত্রী মহাত্মা গান্ধীকে ‘বাপুজি’ সম্বোধন করে বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা বাপুজির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে একটি বিশেষ ডাক টিকিট অবমুক্ত করেছি। আমরা আজ বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাক বিভাগের একটি স্ট্যাম্পের উদ্বোধন করবো।’ এই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানগুলো যৌথভাবে উদযাপনের জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হওয়ায় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার এবং জনগণের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘ডিসেম্বরে বাংলাদেশের মানুষ আনন্দ, মুক্তি এবং উদযাপনের চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে উঠে।’ তিনি এই মাহেন্দ্রক্ষণে গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ নির্যাতিত মা-বোনকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর শহীদ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং আন্তরিক সমর্থন ও সহযোগিতার জন্য ভারত সরকার ও জনগণকে জানাই কৃতজ্ঞতা।’ প্রধানমন্ত্রী এ সময় ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর দিনটিকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, ‘আজকের দিনটি আমার জন্য একটি বিশেষ দিন। ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অধীনে তখনও আমার মা, ছোট বোন রেহানা, রাসেল এবং ছোট্ট ৪ মাসের শিশু পুত্র জয়সহ আমরা বন্দি ছিলাম। ভারতের কর্নেল অশোক তারা (তৎকালীন মেজর) পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বন্দিদশা থেকে আমাদের মুক্ত করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মুক্ত হলেও আমরা মুক্ত হয়েছিলাম ১৭ ডিসেম্বর।’ তিনি বলেন, ‘আমি কর্নেল অশোক তারার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই। সেই সাথে ভারতের সশস্ত্র বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনী সবার প্রতিও আমার ধন্যবাদ। সেদিন আমরা যারা মুক্ত হয়েছিলাম তাদের মধ্যে আমি, রেহনা এবং জয়-আমরা তিনজনই বেঁচে আছি, আর কেউ বেঁচে নেই (৭৫ এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন বঙ্গমাতাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা)।’ ভারতকে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু আখ্যায়িত করে প্রধানমন্ত্রী, ২০১৯ সালের অক্টোবরে নয়াদিল্লির গ্র্যান্ড হায়দ্রাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী মোদির সঙ্গে তাঁর সর্বশেষ বৈঠক এবং ভারতের আতিথেয়তার কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন। প্রধানমন্ত্রী এর পরই কোভিড-১৯ পরিস্থিতির উদ্ভবে বিশ্বব্যাপী লাখো মানুষের মৃত্যু, জীবন-জীবিকা বাধাগ্রস্ত হওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, ‘সম্ভবত করোনা সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ হলো মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা।’ তিনি বলেন, ‘এই বছরের গোড়ার দিকে ঢাকায় আপনাকে স্বাগত জানানোর ইচ্ছা অপূর্ণ থেকে গেছে। তবুও, আমাদের গত শীর্ষ সম্মেলনের দিক-নির্দেশনা অনুযায়ী, এই ক্রান্তিকালে উভয় পক্ষের সংশিষ্ট কর্তৃপক্ষ যেভাবে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা এগিয়ে নিয়েছে-তা প্রশংসাযোগ্য।’ তিনি ২০২০ সালজুড়ে দুই দেশের মধ্যে চলমান রেল রুট দিয়ে বাণিজ্য, উচ্চ-পর্যায়ের পরিদর্শন ও সভা, সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে ভারতীয় পণ্য সামগ্রীর প্রথম পরীক্ষামূলক চালান প্রেরণ এবং কেরোনা পরিস্থিতিতে সহযোগিতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন।
এসময় শেখ হাসিনা ভারতের মত জনবহুল দেশে কার্যকরভাবে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রশংসা করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত ও জনবহুল অঞ্চলে কোভিড-১৯ যেভাবে আপনার সরকার মোকাবিলা করেছে তার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্যাকেজগুলো ছাড়াও, ‘আত্মনির্ভর ভারত’ এর উদ্যোগে প্রবর্তিত অর্থনৈতিক প্যাকেজগুলো প্রশংসনীয়।’ ‘আমরা বিশ্বাস করি, আপনার গৃহীত নীতিমালার মাধ্যমে ভারত বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।’ এ সময় কোভিড-১৯ মোকাবিলায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বাংলাদেশেও আমরা এই মহামারির অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব উপশম করতে ১৪ দশমিক ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, মার্চের গোড়ার দিকে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের পরে তাঁর সরকার আড়াই কোটিরও বেশি মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে মহামারির দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলা করতে ব্যাপক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফলে, আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনে ব্যাপক বিঘœ ঘটা এবং ভোক্তাদের চাহিদা হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি উর্ধ্বমুখী প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে, বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এসময় শেখ হাসিনা আগামী বছর ঢাকায় অনুষ্ঠেয় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণ জানান।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার উদ্বোধনী ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সকল ভারতীয় নাগরিকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের প্রতি শুভেচ্ছা জানান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সব ভারতীয় নাগরিকের পক্ষ থেকে আমি শুভ কামনা জানাই। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও সৃদৃঢ় করতে চেষ্ট করেছি।’ এসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ আত্মত্যাগকারী সবার প্রতি তিনি বিনম্র শ্রদ্ধা জানান। তিনি ২০২১ সালের ২৬ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে বাংলাদেশ সফরের বিষয়ে বলেন, ‘আগামী বছর বাংলাদেশ সফরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাওয়া আমার জন্য সম্মানজনক।’ করোনা মোকাবিলায় ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় ভারত এবং বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করবে বলেও এ সময় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন দুই প্রধানমন্ত্রী। এ বৈঠকে বাণিজ্য, জ্বালানি, কৃষি, পরিবেশসহ বিভিন্ন খাতে পারস্পরিক সহযোগিতার সাতটি সমঝোতা স্মারক সই করেছে বাংলাদেশ ও ভারত। দুই দেশের ভার্চুয়াল সামিট শুরুর আগেই ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় দুই দেশের মধ্যে এসব সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। বাংলাদেশের পক্ষে স্ব স্ব বিভাগের প্রধান কর্মকর্তারা এবং ভারতের পক্ষে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির হাইকমিশনার বিক্রম দোরাইস্বামী এসব স্মারকে স্বাক্ষর করেন। পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে ভার্চুয়াল দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এসব চুক্তি স্বাক্ষর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হয়। এছাড়া ৫৫ বছর পর আবারও নীলফামারীর চিলাহাটি সীমান্ত থেকে পশ্চিমঙ্গের হলদিবাড়ি পর্যন্ত রেল যোগাযোগেরও উদ্বোধন করা হয়। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ওই রেলপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সম্মানে ভারতের ডাক বিভাগ প্রকাশিত একটি স্মারক ডাকটিকিট অবমুক্ত করেন এবং ‘বঙ্গবন্ধু-বাপু ডিজিটাল এক্সিবিশনে’র উদ্বোধন করেন।