ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মার্কেটের অবৈধ দোকানকে বৈধ করার নামে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়রের বিরুদ্ধে। শুধু ফুলবাড়িয়া-২ মার্কেট থেকেই ২০১৮ সালে সাঈদ খোকন ২১ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে দাবি করছেন দোকান মালিক সমিতির সভাপতি। দেলু জানান, সাঈদ খোকনকে টাকা দেওয়ার যথেষ্ট প্রমাণ তার কাছে আছে। কারণ আমি জানি অবৈধ টাকা একবার কারও কাছে গেলে তা আর ফেরত আসে না। সেজন্য সাঈদ খোকনকে টাকা দেওয়ার সময়ে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ রেখেছেন দেলু। তিনি বলেন, ডিএসসিসির সাবেক মেয়র শুধু ডলারে নয়, ইউরো ও পাউন্ডে হাতিয়ে নিতেন অর্থ। তবে সব অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন বলছেন, তাকে হেয় করতেই এ সব ষড়যন্ত্র।
সাঈদ খোকন আরও বলেন, সিটি করপোরেশনের একাউন্ট তো সিটির মেয়রের নামেই হয়। সিটি করপোরেশনের একাউন্ট আমার ব্যক্তিগত নয়। কেউ যদি আমার নামে কোনো একাউন্টে অর্থ দিয়ে থাকেন তাহলে সিটি করপোরেশনের একাউন্ট।
দেলোয়ার হোসেন দেলুর দাবি ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ থেকে সাঈদ খোকন শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা আমার কাছে টাকা দিয়েছেন আমি সাবেক মেয়রকে কাটা দিয়েছি। কিছু ব্যবসায়ী আবার সরাসরি সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের হাতে টাকা দিয়েছেন। সাঈদ খোকনের অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারের মাধ্যমেও সাঈদ খোকন কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন। এমনকি এই রাজস্ব কর্মকর্তা দেলুর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য দেলুর নারায়ণগঞ্জের বাসায় গিয়েছেন। সাঈদ খোকনের এই ঘনিষ্ঠ রাজস্ব কর্মকর্তা যখনই টাকা নেওয়ার জন্য দেলুর নারায়ণগঞ্জের বাসায় গিয়েছেন তখনই সাঈদ খোকনের সঙ্গে দেলুর মোবাইলে যোগাযোগ হয়েছে।
জানা গেছে, সাঈদ খোকন ডিএসসিসির মেয়র থাকাবস্থায় সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে শত অভিযোগ উঠেছিল। গণমাধ্যমেও ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রকাশ হয়েছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনেও (দুদক) এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। কিন্তু সাঈদ খোকনের ঘনিষ্ঠ লোক হওয়ায় ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেননি সংস্থার প্রধান সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। বরং ইউসূফ আলী সরকারের অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেন সাঈদ খোকন। কারণ এই প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা সাঈদ খোকনের অবৈধ টাকা যোগানের ক্যাশিয়ার ছিলেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সূত্র জানায়, ইউসুফ আলী সরদারের বিরুদ্ধে কমিশন বাণিজ্য, দুনীতিসহ নানা অভিযোগ ছিল। তিনি দোকান বরাদ্দের নামে লুটপাট, আত্মীয়-স্বজনের নামে দোকান বরাদ্দ এবং একই ব্যক্তির নামে একাধিক দোকান বরাদ্দ দিয়েছেন। আর অবৈধ দোকান বরাদ্দের টাকার একটি অংশ সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের কাছে চলে যেত। এভাবে সিটি করপোরেশনের শত শত কোটি টাকা ভাগিয়ে নিয়েছেন সাবেক মেয়র।
সাঈদ খোকন সিটি করপোরেশনের মেয়র থাকা অবস্থায় সর্বোচ্চ সময় বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। ফুলবাড়িয়া মার্কেট-২ এর সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলু বলেন, সাঈদ খোকন ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট থেকে ডলারে অর্থ নিলেও অন্য সিটি করপোরেশনের মার্কেটগুলো থেকে ইউরো ও পাউন্ডে অর্থ নিয়েছেন।
দেলোয়ার হোসেন দেলুর এই কথার সূত্র ধরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে খোঁজ নিলে তথ্য পাওয়া গেছে যে সারাদেশে ১২টি সিটি করপোরেশনের মধ্যে সর্বোচ্চ বিদেশ ভ্রমণ করেছেন সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। সাঈদ খোকন বিদেশ যাত্রা নিয়েও রেকর্ড করেছেন। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ইতিহাসের পাতায় সর্বোচ্চ বিদেশ ভ্রমণ করেন সাঈদ খোকন। বিদেশ ভ্রমণ নগরবাসীর কোনো সমস্যা সামাধানে অভিজ্ঞতা অর্জন, প্রশিক্ষণ কিংবা কোনো সেমিনারে নয়, ব্যক্তিগত কাজেই ২০১৮ সালে ৫১ দিন বিদেশে থেকেছেন। আর ২০১৯ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি এ দুই মাস ব্যক্তিগত কাজে ১৫ দিন বিদেশে থাকেন।
সাঈদ খোকনের বিদেশ সফরের ২০১৮ ও ১৯ সালে কিছু হিসাব নিম্নে দেয়া হলো: ২০১৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর ব্যক্তিগত সফরে অস্ট্রেলিয়ায় যান এবং ১৯ দিন কাটিয়ে ১৬ জানুয়ারি ঢাকায় ফেরেন। দেশে ফেরার পর একমাস যেতে না যেতেই ফের ২০১৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ব্যক্তিগত সফরে ২৬ তারিখ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় থাকেন। এরপর ওমরাহ পালনের জন্য ২৯ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সৌদি আরব, আর স্ট্রং সিটি নেটওয়ার্ক গ্লোবাল সামিট ও ব্যক্তিগত সফরে ৭ থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় ছিলেন। এরপর গ্লোবাল ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটের জন্য ১২ থেকে ১৪ সেপ্টম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে। অর্থাৎ, এক বছরে দেশের বাইরে থেকেছেন ৫১ দিন। বিদেশ সফরগুলোর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উন্নয়নে প্রশিক্ষণের নামে মাত্র চারদিন ব্যয় করেছেন, আর ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ৪৭ দিন বিদেশে ছিলেন। এছাড়া ২০১৯ সালে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ২ থেকে ৬ জানুয়ারি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর এবং ২১ থেকে ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে থেকেছেন।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ১২টি সিটি করপোরেশন। এরমধ্যে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন নিঃসন্দেহে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এখানকার মেয়র একটু বেশি বিদেশ সফর করবেন এটি স্বাভাবিক। তবে তা হবে নগরীর স্বার্থ বিবেচনায় রেখে। কিন্তু তা করেননি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন। বিদেশ সফরে দেশের সব মেয়রের রেকর্ড ভেঙেছেন তিনি।
গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের বিষয়ে ডিএসসিসির সাবেক মেয়র সাঈদ খোকন জানান, ‘আমি তো লকডাউনে থাকি, সরাসরি সাক্ষাৎ দেওয়া তো ডিফিকাল্ট। ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের বিষয়টি পুরোনো। ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের বিষয়ে তো অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। এটি নতুন কিছু নয়’।
সাঈদ খোকন বলেন, ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ সিটি করপোরেশন বলছে ৯১১টি দোকান অবৈধ। আমি বলছি এগুলো অবৈধ দোকান নয়। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং সিটি করপোরেশনের বোর্ড সভার স্বীকৃতি সাপেক্ষে সংশোধিত নকশা করে দোকানগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এসব দোকান ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে। সিটি করপোরেশনের বোর্ড সভায় আগে যারা কাউন্সিলর ছিলেন বর্তমানে তাদের ৮০ শতাংশ কাউন্সিলর রয়েছেন। তবে দোকানগুলো বরাদ্দ আমার সময় হয়নি।
তিনি বলেন, মার্কেটে দোকানগুলো ভাড়া দেওয়ার পেছনে সমস্ত কাগজপত্র রয়েছে। সিটি করপোরেশন যে উচ্ছেদ চালিয়েছে সেটি সম্পন্ন অবৈধ। মাকের্টের দোকানিরা বৈধভাবেই সিটি করপোরেশনকে দোকান ভাড়া দিয়েছে। এখন যে অবৈধ উচ্ছেদ চালানো হচ্ছে, এতে হাজার হাজার দোকানি পথে বসে গেছে। একটি ভিন্ন মহল আমাকে হেয় প্রতিপন্ন করতে মাঠে নেমেছে।
ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেটের দোকানগুলোর ভাড়া আমার ব্যক্তিগত তহবিলে দেয়নি, সিটি করপোরেশনের তহবিলে দিয়েছে। সিটি করপোরেশনে মেয়রের নামেই তো তহবিল হয়। সিটি করপোরশন বরাবর অর্থ পে অর্ডার করতে হলে মেয়রের নামেই লিখতে হবে। অন্যকোনো নাম লেখার সুযোগ নেই। তার মানে আমার নামে ব্যাংক একাউন্ট লেখলেই সেটি আমার ব্যক্তিগত তহবিল নয়। সিটি করপোরেশনের তহবিল। সিটি করপোরেশনের একাউন্টে দোকানিরা ভাড়া দিয়েছে। সিটি করপোরেশনের তহবিলে গেলেই সেই ভাড়ার টাকা পাওয়া যাবে।