#চলতি ডিসেম্বরে বায়ুদূষণে রেকর্ড ঢাকার
#৬ ডিসেম্বর ৩১০ বায়ু মান নিয়ে ছিল সবচেয়ে খারাপ অবস্থা
#গতকাল ২২১ বায়ুমান নিয়ে দ্বিতীয় দূষিত শহর ছিল ঢাকা
ধুলোয় ধূসর হয়ে উঠছে রাজধানী ঢাকা। মেট্রোরেল, রাস্ত-ঘাট প্রশস্তকরণসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলার কারণে বিপুলে ধুলোবালি উড়ছে গোটা শহরে। শীতের মওসুমে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় ধুলো গ্রাসে চলে যাচ্ছে এ শহর। সিটি করপোরেশন থেকে প্রতিদিন পানি ছিটিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ধুলার দৌরাত্ম্য। ফলে বাতাসে বাড়ছে দুষণের মাত্রা। এমন দুষণের কারণে শ^াসতন্ত্রের নানা রোগে ভুগছে নগরবাসী। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধরা এতে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। শীতে এমনিতে ঠা-াজনিত রোগের প্রকোপ বাড়ে। তার মধ্যে এসব উটকো ধুলো রীতিমতো অতিষ্ঠ করে তুলেছে জনজীবন।
এর মধ্যে বেশ কয়েকবার বিশে^র সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকা। গত ৬ ডিসেম্বর সবচেয়ে বেশি খারাপ ছিল ঢাকার বায়ু। এদিন বায়ুর মান ছিল ৩১০। এ আগে ৩ ডিসেম্বর ছিল বছরের সবচেয়ে বেশি বায়ু দূষণের রেকর্ড। বিশ্লেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা ও বায়ুর গতিপ্রবাহ না বাড়লে এ অবস্থা আরো অবনতির দিকে যাবে। শিক্ষক ও পরিবেশ বিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের মতে, এত দীর্ঘ সময় ঢাকার বায়ুর মান এত খারাপ থাকেনি। অন্তত গত ৪-৫ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাধারণত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসেই চার-পাঁচবার বায়ুর মান খারাপ থাকে। সর্বোচ্চ ৫ থেকে ৬ দিন এ অবস্থা থাকে। কিন্তু এবার দেখা যাচ্ছে এ পরিস্থিতি ১০ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত স্থায়ী থাকছে।
তিনি বলেন, সাধারণত বে অব বেঙ্গল থেকে বা দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে বাতাস প্রবাহিত হয়। সমুদ্র থেকে বাতাস আসায় সেই বাতাসটা বিশুদ্ধ থাকে। কিন্তু শীতকালে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে যখন বাতাস না আসে, তখন বায়ুর গতিবেগটা অনেক কমে যায়। এটা উত্তর দিক থেকে ঘণ্টায় ৩-৪ কিলোমিটার বেগে আসে। এ কারণে বায়ু দূষণের মাত্রা একটু বেড়ে যায়। তিনি বলেন, এই বায়ু প্রবাহ যেকোনো জায়গার ধোয়া, ধুলা কিংবা দূষণকে অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে না। কারণ, বাতাসের গতিবেগ কম থাকে। অন্যান্য সময় এই ধোয়া ও ধুলা দক্ষিণ থেকে বাতাসে উত্তর দিকে নিয়ে যেত। এটা হিমালয়ে জমা হতো। শীতকালে হিমালয় থেকে উত্তর-পূর্ব দিক হয়ে শীতকালীন ও অন্যান্য বায়ু প্রবাহিত হয়। এটার গতিবেগ কম থাকে। কিন্তু এটা ব্ল্যাক কার্বন ও অন্যান্য দূষিত বায়ু নিয়ে আসে। তার মানে বায়ুর গতিবেগ কম থাকে আবার বায়ু আসতেই ধুলাবালি নিয়ে আসে। আবার তাপমাত্র যখন কমে যায়, তখন এই তাপে জলীয়বাষ্প থাকে। এই জলীয়বাষ্প ধুলা বালুতে ভিজিয়ে ফেলে। ফলে এগুলো উড়ে চলে যেতে পারে না। নিচের স্তরে চলে যায়।
গতকাল দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে আইকিউ এয়ারের ওয়বেসাইটের তথ্য অনুযায়ী, বাতাসের মান ২২১ নিয়ে দূষিত শহরের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ঢাকা। বাতাসের মান ২৬০ স্কোর নিয়ে প্রথম স্থানে ছিল কিরগিজস্তানের বিশকেক এবং ১৯১ স্কোর নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুর, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, বাংলামোটর, শাহাবাগ, প্রেসক্লাব, পল্টন ও মতিঝিলের বিশাল এলাকাজুড়ে মেট্রোরেল প্রকল্প ও রাস্তা প্রশস্তকরণের কাজ চলছে। এর ফলে নগরের অধিকাংশ এলাকায় এখন ধূলোময়। দুই সিটি করপোরেশন দিন রাত পানি ছিটিয়েও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না ধুলো। ফলে প্রতিদিন অফিসযাত্রী নারী-পুরুষ, এবং অন্যান্য কাজে রাস্তায় চলাচলকারী শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত শ^াসকষ্টজনিত রোগের ঝুঁকিতে পড়ছেন। শুধু বাইরে নয়, ঢাকার বায়ুতে ভেসে বেড়ানো ধুলো নিচু তলা থেকে সর্বোচ্চ উঁচু বাসা-বাড়ি ও অফিস আদালতেও চালাচ্ছে আক্রমণ। বিশেষ করে প্রধান সড়কের পাশর্^বর্তী বাড়ি ও অফিসগুলোর ভেতর বাহির ছেয়ে যাচ্ছে ধুলোয়। দরজা-জানালা আটকেও ধুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। ভেন্টিলেটর হয়েও ঘর বা অফিসের ভেতর ঢুকে পড়ছে ধুলো। পরিবেশবিদ ও নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, মেগা প্রজেক্টগুলো কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না। এমনকি ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনাও নেই এসব প্রকল্পের। ফলে ধুলোর কবলে পড়ে নাকাল হচ্ছে নাগরিকরা।
এ ব্যাপারে পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. আহমদ কামরুজ্জমান বলেন, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালে ডিসেম্বরে প্রায় ২০ ভাগ বায়ুদূষণ বেশি হয়েছে। গত বছরে ডিসেম্বরে বায়ুর মান ছিল ১৮৩, এই বছরে ডিসেম্বরে বায়ুর মান ২৩২ চলে গেছে। গত বছরের তুলনায় এই বছর বায়ুর মান ২০ ভাগের মতো বেড়েছে। এ পরিবেশবিদ বলেন, আমাদের ইটের ভাটা, আমাদের মেগা প্রজেক্টগুলো এবারের ধুলোবালি বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ। এছাড়া শীতে ভবন নির্মাণও বেড়ে যায়। ইট-বালুর ব্যবহার বেড়ে যায়। প্রায় ৫০টির মতো সিমেন্ট কারখানা ও প্রায় ১ হাজার ৩শ’র মতো ইটভাটা ঢাকার চারপাশে আছে। এ সময় এদের উৎপাদন ও বেড়ে যায়। আবার এই সময়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িও বেড়ে যায়। ফলে ধুলোর দৌরাত্ম্যও বাড়ে।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাধারণ সম্পাদক ড. আদিলুর রহমান বলেন, শীতের সময় খোঁড়াখুঁড়িতে দূষণের মাত্রা একটু বেশি হয়। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় ভবন নির্মাণের পরিমাণ একটু বেশি। এখানে কন্সট্রাকশন ম্যানেজমেন্টে আমরা অনেক উদাসীনতা দেখি। মনিটরিংসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অত্যন্ত উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়। কনস্ট্রাকশন কোম্পানিগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে এক ধরনের গাইডলাইন দেওয়া আছে। কিন্তু তারা সেটা মানে না। কোম্পানিগুলো কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করছে না।