ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক অপশক্তির মুলোৎপাটনের প্রত্যয় ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের কোটি মানুষ। গতকাল ৪৯তম বিজয় দিবস উদযাপনের আগে শহীদদের স্মরণ করতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিতে শাণিত বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ দৃপ্তকণ্ঠে উচ্চারণ করেছে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বাংলায় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, উগ্রবাদের ঠাঁই নাই। এবারের বিজয় দিবস সঙ্গত কারণেই ভিন্ন আমেজ আর আবহ নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলাদেশি নাগরিকদের জীবনে। ৪৯তম বছর পূর্ণ করে ৫০তম বছরে পা রেখেছে দেশ। সেইসঙ্গে এ ডিসেম্বরেই নিজেদের অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মাসেতুর মূল অবকাঠামোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে বিশ্বের বুকে নিজেদের সক্ষমতার অভূতপূর্ব এক স্মারক তৈরি করেছে জাতি। অপরদিকে ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠী জাতীয় চেতনার বুকে কাটছে আঁচড়।
ভাস্কর্যবিরোধিতা ও বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার মধ্য দিয়ে এ গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে পাকিস্তানি উগ্রবাদী মতাদর্শের কাছে। এতে ক্ষুব্ধ দেশপ্রেমিক মানুষ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন ঐক্য স্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ধর্ম নিয়ে রাজনীতি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একাত্তরের পরাজিত শক্তির দোসররা দেশকে আবার ৫০ বছর আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে। রাজনৈতিক মদদে সরকারকে ভ্রুকুটি দেখানোর পর্যন্ত ধৃষ্টতা দেখাচ্ছে। তিনি বলেছেন, পরাজিত শক্তির একটি অংশ মিথ্যা, বানোয়াট, মনগড়া বক্তব্য দিয়ে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করতে মাঠে নেমেছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘ধর্মের নামে কোনো ধরনের বিভেদ-বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে দেবো না।’
তরুণ প্রজন্মকে বলেছেন, ‘তোমরা তোমাদের পূর্বসূরীদের আত্মোৎসর্গের কথা কখনোই ভুলে যেও না। তাদের উপহার দেওয়া লাল-সবুজ পতাকার অসম্মান হতে দিও না। প্রতিজ্ঞা কর, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এদেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করবে। তবেই ৩০ লাখ শহীদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান তরুণ প্রজন্মের মাঝে নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। তাই এবারের বিজয় দিবসে লাখো মানুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়েছেÑ মৌলবাদ ও ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে উচ্চকিত স্লোগান। গতকাল সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করেছে দেশের জন্য আত্মোৎসর্গকারী বীর সেনানীদের। এবারের জাতীয় স্মৃতি সৌধে বিজয় উদযাপন ছিল অন্যান্যবারের চেয়ে একদমই আলাদা। শুধু জাতীয় স্মৃতিসৌধই নয়, সারা দেশের শহীদ মিনারগুলোতে সমবেত হয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মী, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম বিজয়ের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সমুন্নত রাখার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।
গতকাল স্মৃতিসৌধে আসা তরুণ প্রজন্মেও অনেকেই বলেছেন, পদ্মা সেতু শেষ স্প্যান বসানোর ঘটনায় বিজয়ের এই মাসে নতুন বিজয়ের স্বাদ পেয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ এর পর আবারো বাংলাদেশ বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করল স্বরূপে; নিজের সক্ষমতা প্রকাশের মাধ্যমে। এই বিজয়ও এত সহজে আসে নি। ৭১ এর মত এবারও চলেছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে নানা ষড়যন্ত্র। জাতির পতাকা এখনো খামচে ধরতে চাইছে সেই পুরানো শকুনরা। সেই ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ৪৯ বছর পর তারা ফতোয়া জারি করেছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের ওপর। রাতের আঁধারে চালায় মৌলবাদী থাবা। এই মৌলবাদী আস্ফালন প্রতিহত করতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বাংলার মানুষ।
এবার করোনাভাইরাসের কারণে স্মৃতিসৌধের পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন ছিল। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী স্মৃতিসৌধে না এলেও তাদের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান তাদের সামরিক সচিবেরা। রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে মেজর জেনারেল এস এম শামীম উজ জামান ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মেজর জেনারেল আহমদ চৌধুরী শ্রদ্ধা জানান। তাদের শ্রদ্ধা জানানোর শেষে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মাস্ক গ্লাভস পড়ে শ্রদ্ধা জানান সর্বস্তরের মানুষ। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে নেওয়া হয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা। ছোট ছোট দলে ভাগ করে ভেতরে ঢোকানো হয় শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতাকে। স্মৃতিসৌধ এলাকায় বেশিক্ষণ অবস্থান নিয়ে ছিল সর্তকতা। উৎসবের পরিসর সীমিত কারার পাশাপাশি এবার নেয়া হয়েছে অনলাইনে ভার্চুয়াল কর্মসূচি। এ বিষয়ে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সজল বলেন, ‘করোনার মধ্যে এবারের বিজয় দিবসটা অন্যরকম লাগছে। করোনার পরের বিজয় দিবসে আনন্দ করব।’
সংস্কৃতি কর্মী আব্দুল করীম বলেন, ‘বাংলাদেশ ৫০ বছরে পদার্পণ করেছে। জাতির জনকের শতবর্ষ উদযাপন করছে দেশ। আগামী বছর আমরা পালন করব স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। অথচ মুক্তিযুদ্ধের আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ আমরা এখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। এখনো স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদ। সকল ধর্মের সকল বর্ণের মানুষের দেশ এটি। কোনো একক ধর্ম, একক গোষ্ঠীর উগ্র আধিপত্যের কাছে বাংলাদেশ মাথা নোয়ানোর জন্য জন্ম নেয়নি। সাম্প্রদায়িকতার মুলোৎপাটন না হওয়া অবধি দেশের স্বাধীনতার কোনো অর্থ নেই। এজন্য দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধতা জরুরি।
শুধু তরুণ প্রজন্মই নয়, মৌলবাদী শক্তির মূলোৎপাটনের আহ্বান জানিয়েছেন দেশের রাজনীবিদরাও। গতকাল স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করতে গিয়ে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পরাজিত করে তাদের বিষবৃক্ষ সমূলে উৎপাটনের আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও। দলের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী সাথে কোনো আপস করা হবে না। এই বিজয়ের দিনে আমাদের শপথ নিতে হবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে পরাজিত করার। তাদের যে বিষবৃক্ষ ও ডালপালা বিস্তার করেছে, সেই বিষবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণ করতে হবে।