প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৫ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১ সাল। সকাল বেলা সরাইল, ব্রাক্ষণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ থেকে দুই শতাধিক পাক সৈনিক বিটঘর গ্রামটিকে ঘিরে ফেলে। রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীকে পথ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে আসে। এরপর পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকাররা ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীকে স্থানীয় ছোট খালের পূর্ব পাশে জড়ো করে। তারপর ৮-১০ জনকে একসঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে পর্যায়ক্রমে গুলি করতে থাকে। লাইন থেকে দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে ঘটনাচক্রে বেঁচে যান মন্তাজ উদ্দিন, আশকর আলি ও সফর আলী। এ ঘটনায় গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারেরই একাধিক লোক নিহত হয়েছেন। নির্যাতিত হয়েছেন গ্রামের আরও অনেক নারী-পুরুষ।
একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘পাক হানাদার বাহিনী সরাইল থেকে পায়ে হেঁটে এবং জাফর নদী নৌকা দিয়ে পার হয়ে আমাদের গ্রামে প্রবেশ করে। তারপর তারা লোকজনকে বাড়ি থেকে টেনে হিঁচড়ে ধরে নিয়ে ছোট খালের পাড়ে হত্যা করে লাশ খালের পানিতে ফেলে দেয়। গুলিতে যেসব লোকজনের মৃত্যু হয়নি তাদেরকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছে। তারা গ্রামের পুরুষ লোক যাকেই পেয়েছে তাকেই ধরে নিয়ে হত্যা করেছে।’ এসময় বিটঘর গ্রামের ছেলামত আলীকে পাকিস্তানিরা চড় মেলে ফেলে দেয়। তারপর বুট-জুতা দিয়ে লাথি মারে। তার চোখের সামনে তিন ভাইকে ঘর থেকে বের করে হত্যা করে। এর আগে পাক সেনারা হত্যা করে ছেলামত আলীর পাঁচ মামাকে। এই ছেলামত আলীর বাড়ির সামনে বহু মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার পর যখন শহীদদের লাশ তুলে দাফনের বন্দোবস্ত করা হয়, ঠিক তখনই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে পাকিস্তানি বাহিনী আবার এসেছে। সেই সময় সবাই লাশ ফেলে পালিয়ে যায় জীবন বাঁচাতে। সবাই মিলে লুকায় পাশের ধানক্ষেতে। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর সহায়তায় বহু মানুষকে এক কবরে দাফন করা হয়।
পানিস্বর ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক সদস্য বিটঘর গ্রামের মো. আজিজুল হক জানান, ‘বিটঘর গণহত্যার আগেরদিন শুনতে পেলাম আমাদের পাশের গ্রাম দুর্গাপুর মোল্লাবাড়ির পাশে একজন পাকিস্তানি সৈনিককে হত্যা করা হয়েছে। এই তথ্য জানতে পেয়ে পাক বাহিনী দুর্গাপুরে আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করে। কিন্তু ভুল তথ্যের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী দুর্গাপুর মোল্লাবাড়িতে না গিয়ে বিটঘর মোল্লাবাড়িতে আক্রমণ করে। পরে এই আক্রমণ সব গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনী প্রথমেই মাওলানা রহিম উদ্দিনের বাড়িতে আক্রমণ চালায়। রহিম উদ্দিনের ছেলে হাবিবুর রহমানকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর স্থানীয় নূর বক্সের বাড়ি থেকে ইউনুস মিয়াকে ধরে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসে। আমাদের বাড়িতে এসে আমার পিতা- আব্দুল জব্বার, চাচা- শামসুদ্দিন ও সিরাজ আলীকে ধরে নিয়ে আবু বকর মেম্বারের বাড়িতে যায়। আবু বকর মেম্বারকে ধরে নিয়ে চলে যাওয়ার সময় তার চার বছরের মেয়ে পাক সেনাদের পায়ে ধরে পিতাকে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করতে থাকে। প্রাণ ভিক্ষার আকুতি জানাতে থাকে। তাতে মন গলেনি বর্বর পাক সৈনিকদের। মেয়েটিকে লাথি মেরে ফেলে দিয়েছিল আর তার পিতা ও অন্যদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছিল।’ ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিটঘর গ্রামে আক্রমণ করেছিল। ওই আক্রমণে শহীদ ৮০ জনের মধ্যে এক মায়ের চার সন্তান রয়েছেন। চার সন্তানকে হারিয়ে তাদের মা খালেক ডাক্তারের স্ত্রী পাগল হয়ে যান। আমৃত্যু তিনি পাগলের মত চার সন্তানের কবর আঁকড়ে ধরে বিলাপ করেছেন।
বিটঘর গণহত্যা নিয়ে ‘১৯৭১ গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে একটি গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটি রচনা করেছেন ব্রাক্ষণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমির সভাপতি, কবি ও সংগঠক জয়দুল হোসেন। এই বইটি পাঠ করলে বিটঘর গণহত্যা সম্পর্কে সবিস্তরে জানা যাবে।