আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেই: প্রধানমন্ত্রী
ভোরের পাতা ডেস্ক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২০, ১০:৪৬ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণে তরুণ প্রজন্মকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আসুন, আবারও আমরা শপথ নেই— আমরা যেন লাখো শহিদের রক্তের ঋণ ভুলে না যাই। আমরা যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ভূলুণ্ঠিত হতে না দেই। যুবশক্তি, তরুণ সমাজ ও নতুন প্রজন্মের কাছে অনুরোধ— তোমরা তোমাদের পূর্বসূরীদের আত্মোৎসর্গের কথা কখনই ভুলে যেও না। তাদের উপহার দেওয়া লাল-সবুজ পতাকার অসম্মান হতে দিও না।
মঙ্গলবার (১৫ ডিসেম্বর) বিজয় দিবস উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। ভাষণটি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর আমরা জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা উদযাপন করছি, যদিও করোনাভাইরাসের কারণে আমাদের কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছে। আগামী বছর আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। করেনাভাইরাসের এই মহামারি না থাকলে আমরা যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব উদযাপন করব, ইনশাআল্লাহ। একইসঙ্গে চলবে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালা।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশের অভিযাত্রার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, বঙ্গবন্ধু বলতেন— ভিক্ষুক জাতিকে কেউ সম্মান করে না। আমরা বাংলাদেশের সেই দুর্নাম ঘুচিয়েছি। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আজ একটি সমীহের নাম। আজকের বাংলাদেশ আর অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর বাংলাদেশ নয়, আজকের বাংলাদেশ স্বাবলম্বী বাংলাদেশ। একটা সময় ছিল আমাদের উন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ আসত বিদেশি অনুদান থেকে। আজ বাজেটের ৯৭ ভাগ মেটানো হয় নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ কারও দয়া বা করুণার ওপর নির্ভরশীল নয়। আমরা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছি। জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। আমরা তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে। উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে। তবেই ২০৪১ সালের মধ্যে আমাদের উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হবে।
পূর্বসূরীদের উপহার দেওয়া স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয় নিশান সমুন্নত রাখতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পূর্বসূরীদের আত্মোৎসর্গের কথা মনে রেখে লাল-সবুজের পতাকার অসম্মান যেন না হয়, সে আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে তোমরা তোমাদের পূর্বপুরুষদের বিজয়-নিশান সমুন্নত রাখার শপথ নাও এই বিজয় দিবসে। প্রতিজ্ঞা করো— মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশকে সোনার বাংলাদেশে পরিণত করবে। তবেই ৩০ লাখ শহিদের আত্মা শান্তি পাবে। জাতির পিতার স্বপ্ন পূরণ হবে।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বলেন, ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে আজ আমরা বিজয় দিবস-২০২০ উদযাপন করতে যাচ্ছি। এ বছর আমরা আমাদের মহান নেতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছি। কয়েকদিন পর আমরা আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে পদার্পন করব। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা লাভ করেছি। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমরা করোনাভাইরাস মহামারি মোকাবিলা করে সমগ্র বিশ্বের বুকে নতুন উদাহরণ তৈরি করেছি। প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে নিজেদের অর্থায়নে নির্মাণাধীন পদ্মাসেতু মাত্র সপ্তাহখানেক আগে দেশের দুই প্রান্তকে সংযুক্ত করেছে। পৃথিবীর বুকে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার প্রত্যয় নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশের সব নাগরিককে আমি বিজয় দিবসের আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দেওয়া এই ভাষণে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহিদ, নির্যাতনের শিকার ২ লাখ নারীকে স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতের তৎকালীন সরকার, রাজনৈতিক নেতা এবং সর্বোপরি সাধারণ জনগণদের যারাই মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন জানিয়েছিলেন এবং নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
৭ মার্চ ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতার সেই ঐতিহাসিক ভাষণের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপ্রবাহও সংক্ষেপে তুলে ধরেন তিনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কর্মকাণ্ড তুলে ধরে তিনি বলেন, বাঙালি জাতি মাথানত করেনি। অত্যাচার-নিপীড়ন যত বেড়েছে, বাংলার মুক্তিকামী মানুষ ততই মরিয়া হয়ে শত্রু বাহিনীর ওপর প্রতি-আক্রমণ শাণিয়েছে। অবশেষে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাঙালি অর্জন করে চূড়ান্ত বিজয়। বাংলাদেশ হয় শত্রুমুক্ত।
জাতির পিতা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ শুরু করলেও পঁচাত্তরে তাকে হত্যার মাধ্যমে দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার অপচেষ্টা করার সেই ইতিহাসও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, পঁচাত্তর পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী সরকারগুলো মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত মূল্যবোধগুলো জলাঞ্জলি দিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় নিজেদের আসন চিরস্থায়ী করার পদক্ষেপ নেয়। সামরিক জান্তারা সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ধারাবাহিক অপপ্রচার চালিয়ে, ইতিহাস বিকৃত করে আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে কালিমা লেপনের চেষ্টা করে।
বিদ্রোহী ও জাতীয় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার অংশ— ‘চাহি না জানিতে/ বাঁচিবে অথবা মরিবে তুমি এ পথে,/ এ পতাকা বয়ে চলিতে হইবে/ বিপুল ভবিষ্যতে’ পাঠ করে সবাইকে ফের বিজয় দিবসের বর্ণিল শুভেচ্ছা জানিয়ে ভাষণ শেষ করেন প্রধানমন্ত্রী।