গত রোববার বিক্ষুব্ধ কৃষকরা ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা দাবি আদায়ের জন্য গতকাল সোমবার অনশনে বসবেন। গতকাল তারা সেই অনশনে বসেন। যদিও তা সকাল থেকে বিকেল অবধি ন’ঘণ্টা চলে। এদিকে কৃষকদের আন্দালনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন দিল্লির মূখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি নিজেও অনশনে অংশ নেবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে সরকারের কৌশল নির্ধারণে গত রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের বাড়িতে বসেন দেশটির কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর এবং বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী সোম প্রকাশ। বৈঠক শেষে তোমর আন্দোলন প্রত্যাহরের জন্য কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানান। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক থেকে কৃষকদের দাবি করা কৃষি আইন প্রত্যাহারের কোন ঘোষণা আসেনি। কৃষক আন্দোলন এখন কেবল দিল্লিতে সীমাবদ্ধ নেই। তা ছড়িয়ে পড়েছে বেশ কয়েকটি রাজ্যে। যাদের ভেতরে রয়েছে মহারাষ্ট্র রাজস্থান এবং হরিয়ানাসহ আরও বেশ কয়েকটি রাজ্য। এদিকে কৃষি আইন প্রত্যাহার না করার বিষয়টিতে অনড় রয়েছে ভারত সরকার। কৃষকদের সমর্থন জানিয়ে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানিয়েছেন, তিনি নিজেই এই অনশনে অংশ নেবেন। গত ১৮ দিন ধরে দিল্লি সীমানা অবরোধ করে বসে রয়েছেন পাঞ্জাব ও হরিয়ানার কৃষকরা। কৃষি আইন প্রত্যাহারে সরকারের উপর চাপ বাড়াতে গতকাল সোমবার ন’ঘণ্টার অনশনের ডাক দেন তারা। সিংঘু সীমানায় বসে কৃষক আন্দোলনের নেতা গুরনাম সিংহ চৌধুরী জানিয়েছেন, আইন প্রত্যাহার না-করা পর্যন্ত তাদের আন্দোলন প্রত্যাহারের কোনো প্রশ্নই নেই। যতদিন গড়াচ্ছে, ততই আন্দোলনরত কৃষকদের সমর্থনে এগিয়ে আসছেন দেশের অন্যান্য প্রান্তের কৃষকরা। গরুর পাল নিয়ে দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ে দিয়ে কৃষকরা এগিয়ে আসছেন, এমন একটি ছবি টুইটারে ছড়িয়ে পড়েছে।
ট্রাক্টর মিছিল :একদল কৃষক রাজস্থান থেকে ট্র্যাক্টর মিছিল নিয়ে দিল্লির দিকে আসবার পথে তাদের আটকে দেয় রাজ্য সরকার মনোহরলাল খট্টরের প্রশাসন। রাজস্থান-হরিয়ানা সীমান্তে শাহজাহানপুরের কাছে আটকে দিয়েছে এই গেরুয়া শিবির। তবে তাদের আটকে আন্দোলন স্তমিত করা যায়নি। বরং হিতে বিপরীত হয়েছে। সেখানে বাধা সেখানেই প্রতিবাদ দেখিয়ে কৃষকরা বিক্ষোভ করেন তারা। কৃষক বিক্ষোভের কারণে বন্ধ হয়ে যায় দিল্লি-জয়পুর হাইওয়ে। কেন্দ্রীয় সরকার পরিকল্পিতভাবে তাদের দিল্লিতে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে বলে সরব হয়েছেন কৃষক নেতা শিবকুমার কাক্কা।
সরকারের কৌশল :মোদি সরকার আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করতে অপপ্রচারে নেমেছে বলে অভিযোগ বিক্ষুব্ধ কৃষকদের। তারা জানান, আন্দোলনরত কৃষকদের একাংশ দিল্লি-নয়ডার চিল্লা সীমানার এক দিকের রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নিয়েছে বলে সরকার প্রচার চালাচ্ছে। বিষয়টি সরাসরি অস্ব^ীকার করেছেন কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা গুরনাম সিংহ। তার দাবি, ‘ওই কৃষকদের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই।’ তিনি অভিযোগ করেন, আন্দোলনে ফাটল ধরাতেই এই ধরনের কৌশল নিচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার।
অস্বস্তিতে মোদি সরকার :প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা আন্দোলনে কোনো রফাসূত্র বার না-হওয়ায় অস্বস্তিতে কেন্দ্রও। গত পাঁচদিনে আইআরসিটিসির মাধ্যমে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে প্রায় দু’ কোটি ইমেইল পাঠিয়েছে কেন্দ্র। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে শিখদের জন্য যে ১৩ দফা কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন, তারই সবিস্তার খতিয়ান রয়েছে ওই ই-মেইলে। এখনও পর্যন্ত তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। এদিকে রফাসূত্রের খোঁজে অমিত শাহ ডেকে পাঠান কৃষিমন্ত্রী তোমরকে। কিন্তু বৈঠকের পরে তোমর আন্দোলনরত কৃষকদের উদ্দেশে নতুন কোনো প্রস্তাব আসেনি। তিনি কেবল আন্দোলন প্রত্যাহারের পক্ষে সওয়াল করেন, যা খারিজ করে দিয়েছেন কৃষকেরা। গোটা বিরোধী শিবির যখন কৃষকদের পাশে, তখন কৃষি আন্দোলনকে সামনে রেখে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’ সক্রিয় হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। তিনি বলেন, ‘মোদি সরকার কৃষকদের সম্মান করে। কিন্তু স্পষ্ট করা দরকার, কৃষি আন্দোলনকে সামনে রেখে ফায়দা তুলতে নেমেছে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’। তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ সরকারের এই ঘোষণা থেকেই স্পষ্ট হচ্ছে মোদি সরকার অনেকটা হার্ড লাইনে যাওয়ার পথ খুঁজছে।
কী বলছেন রাজনাথ : কৃষক আন্দোলন যতই গতি পাক, কৃষি আইন নিয়ে পিছিয়ে আসার কোনও প্রশ্নই নেই। রাজধানীর উপকণ্ঠে কৃষকদের বিক্ষোভের উত্তপ্ত আবহের মধ্যে গতকাল সোমবার এমনই বার্তা দিলেন কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কথার সুর ধরে তিনি এই বার্তাও দেন যে, এই আইন কৃষকবিরোধী নয়। তাদের সুবিধার্থেই এই সংস্কার করা হয়েছে। তার কথায়, ‘কৃষিক্ষেত্রকে পিছিয়ে দেওয়ার মতো কোনও পদক্ষেপ করা হয়নি। যে আইন বানানো হয়েছে তাতে কৃষকদের স্বার্থরক্ষাই হবে।’ রাজনাথ বলেন, ‘আমরা কৃষক ভাইদের কথা সব সময়ই শুনতে রাজি। তাদের সব রকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।’ শুধু তাই নয়, সরকার যে তাদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা এবং কথা বলার পক্ষে, সে বার্তাও দেন রাজনাথ।
সহিংস হতে চলেছে আন্দোলন :মোদি সরকারের নানা কূটকৌশলের কারণে আন্দোলন সহিংসতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিশেষ করে কৃষকদের হঠানোর জন্য স্বশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন এই শঙ্কাকে অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে। আবার দাবি না মানার বিষয়ে সরকারের কঠোর অবস্থান তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। গতকাল সকাল থেকেই ভারতের নানা প্রান্তে ৯ ঘণ্টার অনশনে বসেন কৃষকরা। এই অনশন প্রসঙ্গে ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন (বিকেইউ) জানিয়েছে, সরকারের ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা চলছে। বিকেইউ-এর এক নেতা গুরনাম সিংহ চাদুনি আবার অভিযোগ তুলেছেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না (এমএসপি) নিয়ে কৃষকদের ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে সরকার। যে ভাবে আন্দোলন তেতে উঠছে তাতে ভারত জুড়ে এখন একটাই প্রশ্ন, কবে এই সমস্যার সুরাহা হবে, নাকি আন্দোলনের আগুনে পুড়বে সরকার?