মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের ৪৯তম বছর পূর্ণ হবে এবারের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে। আগামী বছরে মার্চে স্বাধীনতার ৫০তম বর্ষে পদার্পণ করবে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার এ সুবর্ণজয়ন্তীর আগেই বাংলাদেশকে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির হাত থেকে মুক্ত করতে চান সাধারণ মানুষ। গতকাল সোমবার শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে এমন প্রত্যাশাই ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
বিশেষ করে সম্প্রতি মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ শক্তির যে আস্ফালন দেখেছে বাংলাদেশ, তা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আকাক্সক্ষার পরিপন্থী বলে মনে করেন রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীরা। তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তির ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই বলে মনে করেন। বলেছেন, পাকিস্তানি মতাদর্শে দিক্ষীত একটি গোষ্ঠী স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতি-সংস্কৃতি-রাষ্ট্রের সর্বত্র সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক মদদ, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে আজ তাদের শক্তি আরো সংহত হয়েছে। ফলে তারা আজ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননা করার সাহস পায়। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য উপড়ে ফেলার হুমকি দেয়। রাতের আঁধারে ভাস্কর্য ভাঙে। এমনকি ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে আজ ধর্ম দিয়ে চ্যালেঞ্জ করছে তারা। প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। দাবি তুলছে মুক্তিযুদ্ধের সংবিধান পরিবর্তনের। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব চিন্তা ও মতের মানুষের। এ দেশে সবাই সমান অধিকার ভোগ করবে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা তাই ১৯৭২-এর সংবিধানের মূলমন্ত্র ছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদ এসব মন্ত্রের স্বপক্ষে ঐক্যের সূতো। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে রহিত করার ঔদ্ধত্য প্রকাশকারী শক্তির সমূলে বিনাশ ছাড়া স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন পূর্ণাঙ্গ হবে না বলেই মত মুক্তিযুদ্ধর পক্ষের রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর। গতকাল রাজধানীর রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের কর্মসূচিতে এসে বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, একাত্তরে পরাজিত শক্তির উত্তরসূরিরা এখন ‘নব্য রাজাকারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। তারা বাঙালি সংস্কৃতি মুক্তিযুদ্ধর স্মারকগুলোর ওপর আঘাত হানছে। অবিলম্বে তাদের রুখে দিতে হবে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে তার ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা এবং কুষ্টিয়ায় ভাস্কর্য ভাঙচুর নিয়ে যখন সারাদেশ প্রতিবাদে মুখর, সেই সময়েই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্মান জানাতে সারা দেশে শহীদ সৌধে মিলিত হয়ে লাখো মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করার প্রত্যয়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই পুষ্পমাল্য নিয়ে একে একে ঢাকার রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে হাজির হতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সংস্কৃতিকর্মী ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা। স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে নিয়ে অনেক বাবা-মায়েরাও চলে আসেন শহীদ বেদীতে। শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গান, কবিতা ও বক্তৃতামালায় বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করেন তারা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শেষ প্রান্তে এসে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পড়ার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদকে দীর্ঘমেয়াদে দমিয়ে রাখার চক্রান্তে এদেশের বুদ্ধিজীবীদের বেছে বেছে হত্যা শুরু করে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা। লেখক, সাংবাদিক, অধ্যাপক, চিকিৎসক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বসহ বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয়রা ছিল খুনিদের প্রধান লক্ষ্য। গণহত্যা চালানোর পর অনেকের লাশ ফেলে দেওয়া হয়েছিল রায়েরবাজারের এই বধ্যভূমিতে। ভোরে বধ্যভূমিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীর নেতাকর্মী ও শিল্পীরা। শ্রদ্ধা জানানো শেষে সংগঠনটির সহ-সাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম বলেন, ‘একাত্তরের পরাজিত শক্তি মৌলবাদীরা আমাদের সংস্কৃতির ওপর এখন হাত দিয়েছে। সোনার বাংলার আদর্শ-অসাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিপরীত পথে বাংলাদেশ এখন চলে যাচ্ছে। ফলে এখন কারো সঙ্গে আলোচনা নয়, প্রতিরোধ করার সময়।’ তিনি বলেন, ‘মৌলবাদী গোষ্ঠীকে নির্মূল করতে হবে এখনই। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাদের স্মরণ করার মধ্য দিয়ে আমরা বলিষ্ঠ হব। মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলব।’ নতুন প্রজন্মকে সচেতন করার জন্য বুদ্ধিজীবীদের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান সঙ্গীতা ঈমাম।
শ্রদ্ধা জানাতে এসে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মাঝে মধ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তারা নানা ছদ্মাবরণে আমাদের সাংস্কৃতির ওপর আঘাত হানার চেষ্টা চালায়। যারা একাত্তর সালে ফতোয়া দিয়েছিল যে মুক্তিযোদ্ধারা সবাই কাফের, তারাই এই অপচেষ্টাগুলো চালাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তির ঐক্য, সংহতি আজকের প্রেক্ষাপটে অনেক বেশি প্রয়োজন। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেতনভাবে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না। যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না সেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া প্রয়োজন, এটা আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে। কারণ এটি প্রকারান্তরে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননা। এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য সাজেদা চৌধুরী বলেন, ‘শহীদদের আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নে জননেত্রী শেখ হাসিনা কাজ করে যাচ্ছেন। কোনো আদর্শই এক দিনে প্রতিষ্ঠা করা যায় না। এটি একটি ধারাবাহিকতার বিষয়।’
সংসদ সদস্য সাদেক খান বলেন, ‘জাতির পিতার নেতৃত্বে দেশ স্বাধীনের সময় তখনও বুদ্ধিজীবীদের হত্যায় মেতেছিল কুচক্রী মহল, এখনও তাদেরই দোসররা নতুন করে ষড়যন্ত্র করছে। নতুন রাজাকারদের আমরা প্রতিহত করব। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করব এই বছর। একইসঙ্গে চলছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। এই দুটো বিষয় মিলিয়ে এবারের বুদ্ধিজীবী দিবসের একটা স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর সন্ধিক্ষণে সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালনকে ‘ক্ষণিকের বিষয়’ হিসেবে বর্ণনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষই অসাম্প্রদায়িক। সে কারণে সাম্প্রদায়িক উগ্র গোষ্ঠীর স্থান কখনও এই দেশে হয়নি, হবেও না। এগুলো ক্ষণিকের জন্য উত্থান হতে পারে। কেননা বাংলার মাটি, বাংলার আকাশ, বাংলার পানি বাংলার বাতাস সব কিছুই অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক মূল্যবোধে সম্পৃক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের চেতনাও ছিল তাই। এই দিনে আমাদের প্রত্যাশা, এদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ ঘটুক।’
গত ছয় বছর ধরে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে ‘কাদামাখা মাইক্রোবাস’ নামের একটি নাটক পরিবেশন করে আসছে চট্টগ্রাম অঞ্চলের থিয়েটার জয়বাংলা। এই দলের নাট্যকর্মী ফরিদা ইয়াসমিন আঁখি বলেন, ‘কেবল বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ঘটনা নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস আমাদের সামনে আরও বেশি বেশি করে নিয়ে আসা উচিত। কারণ এখন চারদিক থেকে আমাদের সংস্কৃতির উপরে যেভাবে আক্রমণ চলছে, তাতে সংস্কৃতিকে ধর্মের সঙ্গে সাংঘর্ষিক একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তি মৌলবাদীরা শহীদ মিনার, স্মৃতি স্তম্ভ, ভাস্কর্য তারা আজ ধ্বংস করে দিতে চায়।’
উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকম-লীর সদস্য মিজান সুমন বলেন, ‘একাত্তর সালে যে মানুষগুলো আমাদের দেশের প্রাণভোমরা বুদ্ধিজীবীদের মেরে ফেলেছিল, বাংলাদেশকে বুদ্ধিহীন করার যে অপচেষ্টাটা তারা করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পরে এসেও তাদের সেই আস্ফালন আমরা দেখতে পাচ্ছি, ঠিক মুক্তিযুদ্ধের সময়ের মতোই আছে।’ তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশকে যদি ৫০ বছর আগেকার সময়েই ফিরে যেতে হয় তাহলে এই ৫০ বছরে আমাদের অর্জনটা কী? সেই হন্তারকদের কবল থেকে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মুক্ত হতে পারেনি। বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে মনে হচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর একটা পাশাপাশি শক্তি এখন হেফাজতে ইসলামের নামে আমাদের সামনে হাজির হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে এসে তারা দাবি করছে বাংলাদেশকে পুরোপুরি একটা মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসাবে গঠন করার জন্য। ভাস্কর্য নিয়ে তাদের যে আস্ফালনটা আমরা দেখছি তা থেকে বোঝা যায় তারা পুরোপুরি জামাতেরই দোসর।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রব বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থানকরীদের বিচার এখনও অসমাপ্ত রয়েছে। তাদের বিচার হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে এই অসমাপ্ত বিচারটা শেষ করে যেতে পারেন আমরা সেটাই চাই।’ আইন ও সালিশ কেন্দ্র-আসকের কর্মী আব্দুর রশিদ বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা এই দেশ সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত হবে। নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে এদেশে চলবে। সেই পরিবেশ আমরা দেখতে চাই।’