ধর্ষণ ও শিশু হত্যার ঘটনায় পাঁচ জেলায় ১৪ জনের ফাঁসি ও ৯ জনের যাবজ্জীবনের দ- দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে তিন বছর আগে চট্টগ্রামে ৯ বছরের শিশুকে দলবেঁধে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে ৮ জনের ফাঁসি, টাঙ্গাইলে দুই শিশু হত্যার মামলায় তিনজনের মৃত্যুদ- ও ৬ জনের যাবজ্জীবন, খাগড়াছড়িতে কিশোরীকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার দায়ে ৩ যুবকের মৃত্যুদ- দেওয়া হয়েছে। রাজবাড়ীতে শিশু ধর্ষণ মামলায় ২ জনের যাবজ্জীবন কারাদ- এবং খুলনায় স্কুলছাত্রী হত্যা মামলায় একজনের যাবজ্জীবন দিয়েছেন আদালত। গতকাল সোমবার পাঁচ জেলার পাঁচ আদালত এ রায় দেন।
চট্টগ্রাম :প্রায় তিন বছর আগে ৯ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণে পর হত্যার ঘটনায় আদালত আট জনের ফাঁসির রায় দিয়েছেন। গতকাল সোমবার এই রায় দেয় চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক জামিউল হায়দার। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিরা হলেন- মইনুল ইসলাম, বেলাল হোসেন, হাসিবুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, মোহাম্মদ হাসান, মো. সুজন, মো. মেহেরাজ ও শাহাদাত হোসেন। আসামিদের মধ্যে ছয়জন অপরাধ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেয়। এ মামলার বিচারে মোট ১৯ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আদালত সূত্রে জানা যায়, ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে আকবর শাহ থানাধীন বিশ্ব কলোনি এলাকায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যা ঘটনায় এ ফাঁসির রায় দেওয়া হয়েছে। এই মামলা দায়ের করেন শিশুটির মা। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এম এ নাসের জানান, মামলার শুরু থেকেই পলাতক ছিলেন এ মামলার আসামি শাহাদাত হোসেন। কারাগারে থাকা বাকি সাতজনকে হাজির করা হয় রায়ের সময়। বিচারক আট আসামির প্রত্যেককে নির্দেশ দিয়েছেন শিশুর মাকে এক লাখ টাকা করে জরিমানা দিতে। এর পাশাপাশি দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদ-ের রায়। মামলার নথি জানায়, ২০১৮ সালের ২১ জানুয়ারিতে মাঠে খেলতে গিয়ে নিখোঁজ হয় নয় বছর বয়সী মেয়ে শিশুটি। ওইদিনই রাতে শিশুটির মা মাঠের পাশের একটি বাড়িতে লাশ পান শিশুটির। এরপর এ ঘটনায় ৯ অক্টোবর আদালতে পুলিশ অভিযোগপত্র দেয় আটজনের বিরুদ্ধে। তদন্ত শেষে অভিযোগ গঠনের পর পরের বছর ২৬ মে বিচার শুরু করেন আদালত।
টাঙ্গাইল :দুই শিশু হত্যার মামলায় তিনজনকে মৃত্যুদ-, তিনজনকে কারাদ- এবং আরও তিনজনকে যাবজ্জীবন দিয়েছে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত। গতকাল সোমবার দুপুরে এ রায় দেন বিচারক সাউদ হাসান। টাঙ্গাইলের কোর্ট ইন্সপেক্টর তানবীর আহম্মেদ জানিয়েছেন, মামলাটি ২০১৬ সালে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে দুই শিশুর হত্যাকা- নিয়ে। এ রায়ে সাজাপ্রাপ্ত প্রত্যেককে করা হয়েছে এক লাখ টাকা করে জরিমানা। এছাড়া এজাহারভুক্ত দুইজনকে দেওয়া হয়েছে বেকসুর খালাস। মামলা সূত্রে জানা যায়, ধামরাই উপজেলার চর চৌহাট গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে নিহত শিশু শাকিল (১০) এবং একই গ্রামের আবু বকরের ছেলে নিহত শিশু ইমরান (১১) হত্যাকা- নিয়ে মামলাটি করা হয়েছে। মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা হলেন, মির্জাপুর উপজেলার সুজানিলজা গ্রামের বাছেদ মিয়ার ছেলে রনি মিয়া (২৫), ধামরাই উপজেলার চর চৌহাট গ্রামের তারা মিয়ার ছেলে মিল্টন (২২) এবং একই গ্রামের শামছুল হকের ছেলে বাহাদুর মিয়া (২২)। এছাড়া, বাকি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্তরা হলেন, ধামরাই উপজেলার চৌহাট গ্রামের আফসার উদ্দিনের ছেলে শাহিনুর এলাইজ শাহা (৩০), শশধরপট্টি গ্রামের মমরেজের ছেলে জহিরুল ইসলাম (২০) এবং মির্জাপুর উপজেলার আমরাইল তেলীপাড়া গ্রামের শাহাদত হোসেনের ছেলে আব্দুল মালেক (৩৫), চর চৌহাট গ্রামের তাজেল মিয়ার ছেলে আরিফ (২৮), আফসার উদ্দিনের ছেলে শামীম মিয়া (২৫) এবং আমরাইল তেলীপাড়ার জব্বার মল্লিকের ছেলে জাকির হোসেন (২৮)। এদের মধ্যে পলাতক আরিফ। আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) খোরশেদ আলম মামলার বিষয়ে জানান, ২০১৬ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকেল ৩টার দিকে মির্জাপুরের হাড়িয়া বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় মাঠে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার জন্য বাড়ি থেকে বের হয় দুই বন্ধু শাকিল ও ইমরান। তারা একই স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। সন্ধ্যা হবার পরও বাড়িতে না ফেরায় তাদের পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি শুরু করে। পরদিন অজ্ঞাত ফোন নম্বর থেকে আসে হুমকি, দাবি করে করে এক লাখ টাকা চাঁদা। পরদিন বিকেল ৪টার দিকে ওই দুই শিশুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয় পার্শ্ববর্তী মির্জাপুরের গুমগ্রাম বাজারের লেবুক্ষেত থেকে। তাদের গলায় ধারালো অস্ত্রের দাগ পাওয়া যায়। এ বিষয়ে ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে থানায় মামলা করেন মামলার বাদী নিহত শাকিলের মা জোসনা বেগম। ওই বছরই ১১ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা এসআই শফিকুল আলম। তবে, এ রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছে আসামি পক্ষের আইনজীবী আবদুল বাকী। তিনি জানান, রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করবেন তারা।
খাগড়াছড়ি :তিন যুবককে কিশোরী হত্যা ও ধর্ষণের দায়ে মৃত্যুদ- দিয়েছে আদালত। গতকাল সোমবার দুপুরে এ রায়ে দেয় খাগড়াছড়ি নারী ও শিশু দমন ট্রাইব্যুনাল। এসময় রায়ের বিচারক ছিলেন মো আবু তাহের। রায়ের পাবলিক প্রসিকিউটর বিধান কানুনগো জানান, দ-প্রাপ্তরা হলেন- ত্রিরন ত্রিপুরা, কম্বল ত্রিপুরা ও রুমেন্দ্র ত্রিপুরা ওরফে রুমেন। দ-প্রাপ্তরা সবাই খাগড়াছড়ি সদরের ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের বেজাচন্দ্র পাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এর মধ্যে পলাতক রয়েছেন কম্বল ত্রিপুরা। আসামিদের প্রত্যেককে এক লাখ টাকা করে অর্থদ- করা হয়েছেও বলে জানান তিনি। তিনি আরো জানান, ২০১৯ সালের ১৩ মে ভাইবোনছড়া ইউনিয়নের বড় পাড়া গ্রামের নিহত কিশোরী ধনিতা ত্রিপুরাকে (১৭) বাসায় একা রেখে দীঘিনালায় বেড়াতে যান তার বাবা মন মোহন ত্রিপুরা ও মা স্বরলেখা ত্রিপুরা। এ সুযোগে ওই তিন আসামি মদ্যপ অবস্থায় ঘরে ঢুকে ধর্ষণ করে তাকে হত্যা করে। পরদিন সকালে পুলিশ তিন যুবককে গ্রেপ্তার করে এলাকাবাসীর সহযোগিতায় । এ ঘটনায় ওই তিনজনকে আসামি করে মামলা করেন নিহতের মা স্বরলেখা ত্রিপুরা। এ ঘটনায় পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয় ২০১৯ এর ২৮ অগাস্ট। এ ঘটনায় ২২ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
রাজবাড়ী :শিশু ধর্ষণ মামলায় দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ দিয়েছেন রাজবাড়ীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত। গতকাল সোমবার দুপুরে আদালতের বিচারক শারমিন নিগার এ রায় দেন। দ-প্রাপ্তরা হলেন-রাজবাড়ী সদর উপজেলার চর শিবরামপুর এলাকার আফজাল মোল্লার ছেলে মিলন মোল্লা ও একই এলাকার আয়নাল প্রামানিকের ছেলে রেজাউল প্রামানিক। মামলা সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ওই শিশু বাড়ির পাশে ঘাস কাটতে যায়। এ সময় মিলন মোল্লা ও রেজাউল প্রামানিক তাকে ধর্ষণ করে। পরদিন বিষয়টি জানতে পারে শিশুটির মা। ওইদিনই বাদী হয়ে রাজবাড়ী সদর থানায় ধর্ষণ মামলা দায়ের করেন শিশুটির মা। পরবর্তীতে আদালতে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। মামলার দীর্ঘ শুনানি শেষে আদালতের বিচারক আসামিদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন।
খুলনা :খুলনার রূপসা উপজেলায় স্কুলছাত্রী শিমলা খাতুন (১২) হত্যা মামলায় আসামি রনি হাওলাদারকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো এক বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে। সোমবার দুপুরে খুলনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মশিউর রহমান চৌধুরী এ রায় দেন। রনি উপজেলার গোয়াল বাধান এলাকার রবিউল হাওলাদারের ছেলে। রায় ঘোষণাকালে সে আদালতে উপস্থিত ছিল। আদেশে মশিউর রহমান চৌধুরী বলেন, মামলার শুনানিতে পাওয়া সাক্ষ্যপ্রমাণে আসামির মৃত্যুদ- দেওয়া যায়। কিন্তু আসামির বয়স কম হওয়ায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হয়েছে। মামলার বিবরণে জানা গেছে, শিমলা রূপসার কাজদিয়া হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী। ২০১৬ সালে আসামি জসিম শিমলাকে প্রেমের প্রস্তাব দেয়। কিন্তু শিমলা রাজি না হলে জসিম ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে অনুযায়ী ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর সকালে জসিম নিজে ছুরি ও হাসুয়া ক্রিকেট সামগ্রীর ব্যাগে নিয়ে বাসা থেকে বের হয় এবং রনিকে সঙ্গে নিয়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে শিমলার ওপর আঘাত করে। হত্যা নিশ্চিত করে জসিম ছুরি নিজ বাসার পাশের পুকুরে ফেলে দেয় আর হাসুয়া ঘরে রাখে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে শিমলার ভাই আকাশ ও প্রতিবেশিরা তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে রূপসা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় শিমলার বাবা সরোয়ার শেখ বাদী হয়ে রূপসা থানায় মামলা দায়ের করেন। তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক গোলাম রসুল ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট চার্জশিট দাখিল করেন। আদালতে ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারি এ মামলার বিচার শুরু হয়। শুনানি চলাকালে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। মামলার চার্জশিটভুক্ত অপর আসামি জসিম অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায় শিশু আদালতে তার বিচারিক কার্যক্রম চলছে। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন জেলা পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট এনামুল হক।