শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগে মন্ত্রণালয়ের গড়িমসি নাকি অন্যকিছু?
রহস্যজনক কারণে প্রায় ১ মাস পার হওয়ার পরও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে প্রধান প্রকৌশলী নিয়োগ দিচ্ছে না শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে করোনা আক্রান্ত শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের আন্তরিকতার ঘাটতি রয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন খোদ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীরা।
শিক্ষা খাতের উন্নয়ণে সরকার সর্বাধিক বাজেট বরাদ্দ প্রদান করে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণ, অবকাঠামো উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত ও সংস্কার, আসবাবপত্র সরবরাহের মাধ্যমে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি) সরকার উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। অথচ প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রকৌশলী পদটি শুন্য। গত ১৯ নভেম্বর ইইডির প্রধান প্রকৌশলী বুলবুল আখতার অবসরে গেছেন।
তিনি অবসরে যাওয়ার পর অতিরিক্ত দায়িত্ব বা রুটিন ওয়ার্কেরও দায়িত্ব কাউকে দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির সারাদেশের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়ছে। নতুন দরপত্র আহ্বান, পুরনো দরপত্রের নিষ্পত্তি, ঠিকাদারদের বিল ছাড়করণ, বিভিন্ন কেনাকাটায় অনুমতি, ডিজাইন ও ড্রয়িং অনুমোদন ছাড়াও ইইডির সব ধরনের প্রশাসনিক কাজে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিল না পেয়ে ঠিকাদাররা পড়েছেন অর্থিক সংকটে। প্রতি বছর এসময় অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিল ছাড় করানো হয়। যা প্রধান প্রকৌশলীর নির্দেশনা অনুযায়ী হয়ে থাকে। গুরুত্বপুর্ণ পদটি শূন্য, দিক নির্দেশনার কেউ না থাকায় সারাদেশের কাজে স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজন প্রকৌশলী।
প্রধান প্রকৌশলীর পদ শুন্য থাকায় কাজের চাপ নেই, তাই শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় অলস সময় পার করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। প্রধান প্রকৌশলীর পদটি দীর্ঘদিন শূন্য থাকলে পরবর্তিতে কাজের দীর্ঘসূত্রিতা ও নানা জটিলতার সৃষ্টি হবে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
এদিকে, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বর্তমান-সাবেক মিলিয়ে অন্তত অর্ধ ডজন নির্বাহী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর বিভিন্ন দুর্নীতি এবং অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান কাজ চলছে ধীরগতিতে। ২০১৬ থেকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিভিন্ন দুর্নীতি ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করলেও এখনো পায়নি তা চূড়ান্ত রূপ। এরই মধ্যে একবার অনুসন্ধান কর্মকর্তা বদল হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
প্রকৌশলীদের মধ্যে রয়েছেন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের ঢাকার প্রাক্তন নির্বাহী প্রকৌশলী মির্জা নজরুল ইসলাম, শেখ মো. মমিনুল হক, আফরোজা বেগম ও শাহ নাইমুল কাদের, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী এ কে এম মজিবুর রহমান এবং মজিবুর রহমান সরকার।
তাদের বিরুদ্ধে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন, নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণে দুর্নীতি, ঘুষ লেনদেন, সরকারি অর্থের অপচয় এবং দায়িত্বে অবহেলাসহ বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার অভিযোগ ছিল। নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে মির্জা নজরুল ইসলাম, শেখ মো. মমিনুল হক, আফরোজা বেগম ও শাহ নাইমুল কাদের বিভিন্ন অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় বেপরোয়া কমিশন বাণিজ্য ও স্বেচ্ছাচারিতায় নিজের পছন্দমত ব্যক্তি এবং নিজের ভাই ও আত্মীয়-স্বজনদের প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়েছেন।
এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক দুর্নীতি, সরকারি অর্থ অপচয় ও লুটপাট হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ নজর না থাকায় নির্বিঘ্নে চলেছে ওই দুর্নীতি। কাজের নকশা পরিবর্তন করে পছন্দের ঠিকাদারকে সুবিধা দেওয়া এবং ঠিকাদারদের কাছ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ নেয়া হয়। সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ভবন নির্মাণ ও মেরামতের কাজ ইইডির ঢাকা জোনাল অফিসের মাধ্যমে করা হয়। এর মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে বণ্টন করা হয়েছে। আর এর মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন ওই কর্মকর্তারা।
দুদক সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ মাঝামাঝি সময়ে এমন অভিযোগে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর দুদকের উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে দুই সদস্যের টিম গঠন করা হয়। টিমের অপর সদস্য ছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক সালাহউদ্দিন আহমেদ। এই টিম ২০১৭ সালে অক্টোবরে অনুসন্ধান প্রতিবেদন তৈরি করলেও বিভিন্ন অসঙ্গতির কারণ দেখিয়ে কমিশন পুনরায় অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়। এরপর দুদক উপপরিচালক জাহাঙ্গীর আলম অন্যত্র বদলি হওয়ায় অনুসন্ধান কর্মকর্তা পরিবর্তন করে সহকারী পরিচালক এস এম সাজ্জাদ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই মধ্যে শিক্ষা প্রকৌশলী অধিদপ্তরের বেশকিছু কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক।
উল্লেখ্য, এবার অবসরে পাঠানোর আদেশ জারির পর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের (ইইডি) অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী বুলবুল আখতারকে তড়িঘড়ি করে প্রধান প্রকৌশলীর পদে পদোন্নতি দেয়া এবং চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের তোড়জোড় চালিয়েছিল শিক্ষা প্রশাসনের একটি চক্র। দুর্নীতিবাজ এবং জামায়াত শিবির পৃষ্ঠপোষক বুলবুল আখতারকে একটি খসড়া বিধিমালার আলোকে বিতর্কিত এ প্রকৌশলীকে দেয়া এবং তার চাকরির মেয়াদ দুই বছর বৃদ্ধির প্রস্তাব সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সভায় তোলা হয়েছিল বলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। কিন্তু এবার ডা. দীপু মনি এবং ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল চাইছেন, বিতর্কিহীন কাউকে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী করতে। এক্ষেত্রে তারা যাচাই বাছাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলেও নিশ্চিত করেছে মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র। সূত্রটি বলেছে, বর্তমান সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে যদি বুলবুল আখতারের মতো কেউ দেশবিরোধী জামায়াত সিন্ডিকেটকে সহায়তা করে, সেটা অত্যন্ত পরিতাপের। এই কারণেই হয়তো যারা এই পদের জন্য আগ্রহী এবং যোগ্য রয়েছেন, তাদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। তবে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই এই নিয়োগ হতে পারে বলেও জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র।
উল্লেখ্য, শিক্ষা প্রকৌশল অধিপদপ্তরের সরকারি ওয়েব সাইটে এখনো প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে জামায়াত পৃষ্ঠপোষক বুলবুল আক্তারের পরিচয়ই দেয়া আছে। কিন্তু তাকে ২০ নভেম্বর থেকে অবসর ছুটি মঞ্জুর করা হয়েছে। বুলবুল আখতারকে অবসরোত্তর ছুটিতে পাঠানোর আদেশ জারি হয় গত ৫ নভেম্বর। তাকে পদোন্নতি পাইয়ে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত ছিল বিতর্কিত একজন ঠিকাদার, যার কব্জায় শিক্ষায় অবকাঠামো নির্মাণের সবচেয়ে বেশি কাজ রয়েছে। এ ঘটনায় শিক্ষা প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে; আওয়ামীলীগপন্থী প্রকৌশলীদের মধ্যেও তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে।
ইইডি’র শীর্ষ কর্মকর্তার প্রশাসনিক অদক্ষতা, গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণেই শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অবকাঠামো নির্মাণ কাজ গত এক-দেড় বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে ভোলা সরকারি কলেজে নিম্নমানের চারতলা ভবন নির্মাণের দুর্নীতি ধামাপাচা দেয়ার চেষ্টাসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। গত ২৮ আগস্ট শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর কর্মকর্তা কর্মচারী পরিষদের ব্যানারে জামায়াত সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুলে সচিব বরাবর অভিযোগ করা হয়েছিল; যাতে বলা হয়, শীর্ষ কর্মকর্তার ভাই শাহাদাত হোসেন মানিক ১৯৯৪ সালে রাজশাহী সিটি কলেজ শাখা ছাত্রশিবিরের বাইতুলমাল সম্পাদক ছিলেন।