#নতুন প্রজন্মকে সেই একাত্তরের প্রেতাত্মাদেরকে চিনিয়ে দিতে হবে: ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
#বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে আরও মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে: অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল।
#অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আমাদের সবাইকে একত্রিত হতে হবে: ড. নূর রহমান।
#আজকের নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করছে: শমী কায়সার।
‘মুজিববর্ষ’ ও করোনা মহামারির মধ্যে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের অনন্য মুহূর্ত এসেছে। আমরা স্মরণ করছি ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর নির্মম মৃত্যুর করতলে প্রাণ দিয়ে আজো যারা দিশারি তাঁদের অবদানকে। বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে ঘটে এক মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞ। তারা বেছে বেছে অসংখ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের হত্যা করে।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১৮৮ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। সোমবার (১৪ ডিসেম্বর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এর উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল, ব্রুনাই বঙ্গবন্ধু পরিষদের উপদেষ্টা, অস্ট্রেলিয়া বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাবেক সভাপতি এবং সাবেক ছাত্রনেতা ড. নূর রহমান, এফবিসিসিআই এর পরিচালক (শহীদ পরিবারের সন্তান) শমী কায়সার। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, ধন্যবাদ আমাদের বিজ্ঞ সঞ্চালক সহ আজকে আমন্ত্রিত বক্তাদেরকে এবং ভোরের পাতা সংলাপের কর্তৃপক্ষদেরকে এইরকম একটি মহান দিবসে একটি মহৎ উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। আজকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। পৃথিবীর ইতিহাসে আজকের দিনটি অন্যতম একটি এক কালো অধ্যায়। আমাদের দেশের সূর্য সন্তানেরা দেশের স্বাধীনতার লগ্নে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আজকের এইদিনে বাঙালি বুদ্ধিজীবী নিধন বাংলাদেশের ইতিহাসে নৃশংসতম ও বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ। জাতি যখন বিজয়ের খুব কাছে সেই সময় পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে ধরে হত্যা করে। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। বাঙালি শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, আইনজীবী, শিল্পী, দার্শনিক ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদগণ এই সুপরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হন। তারা পরিকল্পিতভাবে আমাদের এই জাতিকে নেতা শূন্য করার জন্য তাদেরকে সেদিন বধ্যভূমি নিয়ে তাদেরকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পরপরই মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে স্বজনের লাশ খুঁজে পায়। বুদ্ধিজীবীদের নিথর দেহজুড়ে ছিল আঘাতের চিহ্ন, চোখ, হাত-পা বাঁধা, কারও কারও শরীরে একাধিক গুলি, অনেককে হত্যা করা হয়েছিল ধারালো অস্ত্র দিয়ে জবাই করে। লাশের ক্ষতচিহ্নের কারণে অনেকেই তাদের প্রিয়জনের মরদেহ শনাক্তও করতে পারেননি। এটি অনেকটা যুদ্ধের পরিকল্পনাবশত তারা এটা করেছে। যখন তারা দেখেছে কোনভাবেই আমাদের স্বাধীনতার যে সূর্য তা স্তব্ধ করা যাচ্ছে না তখন তারা জাতিকে মেধা শূন্য করার তাগিদ থেকে এই জঘন্যতম কাজটি করে। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে এদেরকে যারা সহযোগিতা করেছে তারা কারো ছাত্র, কারো বন্ধু, কারো আত্মীয় ছিল। এইযে নেতা শূন্য করার যে ঘটনা তারই ধারাবাহিকতায় গত কয়েকদিন আগে কুষ্টিয়াই সেই উগ্র ভাবাদর্শের লোকেরাই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাঙচুর করেছে। এদের কাজ গুলো ঐ প্রেতাত্মাদের প্রতিধ্বনি। সুতরাং আমাদের এই দিবসে প্রতিজ্ঞা করতে হবে এবং নতুন প্রজন্মকে জানান দিতে হবে তারা এখনো বিলুপ্ত হয়নি এবং তারা যেখানেই থাকুকনা কেন এদেরকে চিহ্নিত করে কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল বলেন, ১৯৭১ আজকের এই দিনটির ঠিক দুই দিন পরে যখন আমরা বিজয় অর্জন করবো ঠিক তখনি আমাদের এই আনন্দঘন মুহূর্তকে চিরতরে কালো ছায়া এঁকে দিয়ে গেছে। এবং এটি কিন্তু হঠাৎ কোন সংঘর্ষ ছিলনা। আমরা জানি যে, কোন যুদ্ধে যখন কোন বাহিনী পরাজিত হতে থাকে তখন তারা সেই দেশে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। পাকিস্তানের ২৪ বছরে এদেশে অবকাঠামো তৈরি হয়নি বললেই চলে। আর যা কিছুও বা উত্তরাধিকার সূত্রে এদেশে গড়ে উঠেছিল ঔপনিবেশিক শাসকদের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। সেটিও ধ্বংস করে দিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানিরা মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে। এরপরে তারা দেশে আরও দুটি জঘন্য কাজ করেছিল। এইরকম ঘটনা অন্য কোন দেশের যুদ্ধের সময় হয়েছি কিনা আমার জানা নেই। তারা একটি সংকর জাতি তৈরি করতে চেয়েছিল। পাকিস্তান সেনারা বাঙালি মহিলাদেরকে ব্যাপক ভাবে ধর্ষণের অনুমতি দিয়ে এইদেশে একটি সংকর জাতি গড়ে দিতে চেয়েছিল যাতে বাঙ্গালিরা দেশের স্বাধীন অস্তিত্ব ধরে রাখতে না পারে। ২য় যে কাজটি করা হয়েছিল, সেটা হলো আমাদেরকে মেধা শূন্য করার জন্য বুদ্ধিজীবীদেরকে হত্যা করা হয়েছিল। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের রাতের আঁধারে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যেয়ে রায়েরবাজারের বধ্যভূমিতে পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্যই ছিল বাংলাদেশকে মেধা শূন্য করে দেয়া। অবকাঠামো আর অর্থনীতির ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যায় কয়েক বছরে কিন্তু মেধার ঘাটতি পূরণ হয় না কয়েক যুগেও। এর খেসারত দিয়েছে বাংলাদেশও। ’৭১’র ভগ্নস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে মাত্র তিন বছরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে পরিণত করেছিলেন সাত শতাংশ প্রবৃদ্ধির ক্রম বিকাশমান অর্থনীতিতে। তারপরও সংগঠিত হয়েছিল ১৫ আগস্ট।
ড. নূর রহমান বলেন, আজকে ঐতিহাসিক বুদ্ধিজীবী দিবস। বাংলাদেশকে মেধা শূন্য করার জন্য, জাতিকে নেতা শূন্য করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ের প্রাক্কালে আমাদের দেশের সূর্য সন্তানদের একটি লিস্ট তৈরি করে রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা তাদেরকে বেছে বেছে হত্যা করে। এই সূর্যসন্তানরাই জাতির যেকোনো বিপর্যয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে জাতিকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসক ও শোষক চক্রের অন্যায় অত্যাচার ও শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে তারা ছিলেন দিকনির্দেশক এবং সোচ্চার কণ্ঠ। বুদ্ধিজীবীরা কেউই কিন্তু রাজনীতিবিদ ছিলেন না, মিছিলের মুখ ছিলেন না অনেকে। অথচ স্বাধীনতার ঠিক আগ মুহূর্তে হত্যা করেছিল শিক্ষক, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসক এমন অনেককেই। বুদ্ধিজীবীরা রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক, নৈতিক মনোবল ধরে রাখতে সহায়তা, সাহস জোগানো এবং জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এক কথায় যদি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের দিকনির্দেশকদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বুদ্ধিজীবীরাই ছিল অগ্রভাগে। আমারা যদি এখনো লক্ষ্য করি, আমাদের দেশের স্বপ্ন দ্রষ্টা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এইদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠন করার উদ্দেশ্যে এই দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন। তিনি ছিলেন একমাত্র লিডার যিনি কিনা সমগ্র বাংলাদেশের সবাইকে একটি ছায়াতলে নিয়ে এসেছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা আজ বেঁচে থাকলে হয়ত স্বাধীন বাংলাদেশে পরাজিত শক্তি আবার ঐক্যবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেত না। স্বাধীনতার অর্ধ দশক পর বাংলার রাজনীতিতে তাদের উত্থান হত না।
শমী কায়সার বলেন, আজকে আমি বিনম্র চিত্রে স্মরণ করছি সকল বুদ্ধিজীবী সহ মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদদেরকে এবং ভোরের পাতাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি আজকে আমাকে এই সংলাপে আমন্ত্রণ করার জন্য। এইযে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়টা, এটা কিন্তু বাংলাদেশে বহু সময় ধরে এই দিনটা শুধু আনুষ্ঠানিকতা ছিল। কিন্তু আজকে ২০২০ সালে এসে এই দিবসটি শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পুরো জাতি আজকের দিবসটাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে। আমাদের ছোট বেলায় যা হতো সেটা ছিল, আমাদের মায়েরা বাবার স্মৃতিগুলো বলতে বলতে একসময় ক্লান্ত হয়ে যেতো। কিন্তু এখন আর সেই সময়টি নেই। এখন আমরা গর্ব করে বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারি কারণ এখনকার বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার হয়েছে এবং অনেক কিছুই বিচারের প্রক্রিয়ায় আছে। আজকে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করছে। নতুন প্রজন্মের বাঙালিরা গভীর শ্রদ্ধা ও বিনয়ে স্মরণ করছে আজকের এই দিনটিকে। আজকে আমি একটা কথা সব দর্শকদেরকে বলতে চাই যে, এই যে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছিল, তাদেরকে কেন হত্যা করা হয়েছিল। এই বুদ্ধিজীবীরাই বঙ্গবন্ধুর সাথে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন গড়ার জন্য যে যার প্রেক্ষাপট থেকে অবদান রাখতেন। কেউ শিক্ষা ক্ষেত্রে, কেউ চিকিৎসা ক্ষেত্রে, কেউ সাহিত্য দিয়ে, কেউ চলচ্চিত্র দিয়ে বাঙলার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাদের কারণেই বহু মানুষ অনুপ্রাণিত হয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তারা সবাই একই স্বপ্ন দেখেছিলেন সেটা হলও স্বাধীন বাংলাদেশের। আজকে এই সংলাপের দ্বারা মিডিয়ার কাছ অনুরোধ করতে চাচ্ছি, এইযে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সহিদুল্লাহ কায়সার, মুনীর চৌধুরী, মোফাজ্জল হায়দার, আলতাফ মাহমুদদের মত আরও অনেক বুদ্ধিজীবীদের গল্প যেন আমরা তরুণ প্রজন্মদের কাছে বেশি বেশি করে তুলে দিতে পারি।