ড. চৌধুরী নাফিজ সরাফাত
অনেক অর্থনীতিবিদের ধারণা, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের জিডিপি ৩ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর সেটি ঘটলে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের অর্থনীতিকে দেখা যাবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে। মানুষের জীবন-মানে আসবে অভাবনীয় পরিবর্তন।
বহুল কাঙ্ক্ষিত পদ্মা বহুমুখী সেতুর শেষ স্প্যানটি বসার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য সূচিত হলো গর্বিত এক নতুন অধ্যায়ের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রত্যয় এবং পর্বতসম অটল শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে সব অপশক্তি। কারো অনুদানে নয়, সম্পূর্ণ দেশীয় অর্থায়নে প্রমত্তা পদ্মাকে পরাস্ত করে এখন পুরোপুরি দৃশ্যমান দেশের দীর্ঘতম সেতু।
এই সেতু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগে নিয়ে আসবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সেই সঙ্গে বদলে যাবে গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতি।
২০০৮ সালের নির্বাচনি ইশতেহারে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। নির্বাচনে বিজয়ের পর সরকার গঠন করেই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংক, জাইকা অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিও দেয়। কিন্তু ঘুষ দুর্নীতির কাল্পনিক অভিযোগ তুলে পরে ১২০ কোটি ডলারের অঙ্গীকার থেকে সরে যায় বিশ্বব্যাংক। অন্য বিদেশি সংস্থাগুলোও একই পথ অনুসরণ করে।
কঠিন সেই সময়ে অবিচল প্রধানমন্ত্রী দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দিয়েছিলেন, স্বপ্নের পদ্মা সেতু হবেই এবং তা সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে। দেশ-বিদেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদেরা সে সময় এই ঘোষণায় বিস্মিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সামর্থ্য নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলেছিলেন। তবে তাদের অবিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশের সক্ষমতা, সমৃদ্ধি, অহংকার ও সাহসের প্রতীক হিসেবে পদ্মার বুকে এখন দৃশ্যমান সেতুর মূল কাঠামো।
দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক বিপুল গতি তৈরি হবে পদ্মা সেতুর কারণে। এরই মধ্যে সরকারের সম্ভাব্যতা জরিপে বলা হয়েছে, সেতুটি চালু হলে দেশের জিডিপি ১ দশমিক ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আয় বাড়বে এক দশমিক চার শতাংশ, ৭ লাখ ৪৩ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে।
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পদ্মা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়বে ১ শতাংশ হারে। জাইকার সমীক্ষাতে বলা হয়েছে, জিডিপি বাড়বে ১ দশমিক ২ শতাংশ। পদ্মা সেতু দিয়ে প্রতিদিন ২১ হাজার ৩০০ যানবাহন চলাচল করবে। ২০২৫ সালের দিকে এ সংখ্যা বেড়ে হবে ৪১ হাজার ৬০০।
এসব হিসাবের বাইরে অনেক অর্থনীতিবিদের ধারণা, পদ্মা সেতুর কারণে দেশের জিডিপি ৩ থেকে ৪ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর সেটি ঘটলে কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের অর্থনীতিকে দেখা যাবে সম্পূর্ণ নতুন রূপে। মানুষের জীবনমানে আসবে অভাবনীয় পরিবর্তন। ২০৪১ সালে ১৬ হাজার ডলারের বেশি মাথাপিছু আয় নিয়ে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন বাংলাদেশের সামনে, সেটা পূরণ সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ। টাকার অঙ্কে আকার ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর কারণে প্রথম বছরে জিডিপি যদি দেড় শতাংশও বাড়ে তাহলেও এর সার্বিক অর্থমূল্য হবে ৪১ হাজার ৯৪৫ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
আর জিডিপি ৩ শতাংশ বাড়লে সার্বিক অর্থনীতিতে ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি স্ফীতি ঘটবে প্রথম বছরেই।
এই সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ২৭ জেলায় ভারী শিল্পের পাশাপাশি এসএমই খাতে বিপ্লব ঘটবে। বিকশিত হবে পর্যটন খাত। পায়রা সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাড়বে পণ্য আমদানি-রফতানি। পায়রা ও মোংলা বন্দর, বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। এতে আমূল বদলে যাবে পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতি।
পদ্মার দুই পারে আধুনিক স্যাটেলাইট সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে। এরই মধ্যে বদলে গেছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। সেতু চালু হলে ট্রেন পৌঁছাবে দক্ষিণের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত।
মাত্র কয়েক বছর আগেও এসব ছিল গল্পের মতো। এখন তা বাস্তবে রূপ নেয়ার দ্বারপ্রান্তে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণেই স্বপ্নের চূড়া স্পর্শ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলার পথে গোটা জাতিকে এগিয়ে দিচ্ছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
লেখক পরিচিতি: চেয়ারম্যান, পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড, সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি, নিউজবাংলা টোয়েন্টিফোর ডটকম