প্রকাশ: শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:১২ পিএম আপডেট: ১১.১২.২০২০ ৭:১৮ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
পৃথিবীর সূচনালগ্ন থেকেই অহেতুক হানাহানি, দ্বন্ধ-সংঘাত, ন্যায়-অন্যায়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ-বিগ্রহে অনেক দেশ ও জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। যুদ্ধ সৃষ্টি হওয়ার পেছনে কারণ হলো- কেউ কাউকে মেনে নিতে পারে না, কারো প্রস্তাবে কেউ রাজি হয় না কিংবা অন্যের কাছে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব হারাতে চায় না। তাই তো যুদ্ধ আজ বিশ্বব্যাপী। যুদ্ধ কোনভাবেই কল্যাণকর নয়। যুদ্ধের মাধ্যমে শুধু যে যুদ্ধরত দুটি দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও আক্রান্ত হয়ে পড়ে। নিকট অতীতে যেসব দেশে যুদ্ধের দামামা বেজেছে ওই সব দেশে দুর্ভিক্ষ, দারিদ্রতা, অজ্ঞতা, ঝেঁকে বসেছে। অর্থনৈতিক এবং স্বাভাবিক জীবন যাত্রার কাংখিত মান ফিরিয়ে আনতে পারেনি অধিকাংশ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। সম্প্রতীক সময়ে ভারত ও পাকিস্তানে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার প্রহর গুণছে। এ প্রেক্ষিতে আশপাশের দেশগুলোর আপামর জনসাধারণ শঙ্কিত। পারমাণবিক শক্তিধারী ভারত-পাকিস্তানে যুদ্ধ বাধলে ‘পারমাণবিক অস্ত্রে’র ব্যবহার অনিবার্য হয়ে পড়বে। ১৯৪৫ সালে আমরা হিরোসিমা ও নাগাসিকায় ‘পারমানবিক’ শক্তির অপব্যবহার প্রত্যক্ষ করেছি। নিমিষে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং পরবর্তী সময়ে পরিবেশের ওপর তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দীর্ঘ ৭০ বছর ধরে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে মানব সভ্যতাকে।
যুদ্ধ-গবেষকরা বলছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পুরোদস্তুর যুদ্ধ বাধলে প্রতিবেশী দু’টি দেশেরই অর্থনৈতিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে। ফলে দু’টি দেশই পিছিয়ে যাবে কয়েক দশকের জন্য। দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ হলে তা শুধু এই উপমহাদেশেই নয়, গোটা এশিয়ার পক্ষেই মারত্মক ক্ষতির কারণ হবে। রাটগার্স বিশ্ববিদ্যালয়, কলোরাডো-বোল্ডার ও লস এঞ্জেলেসের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলিত গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশের বাসভূমি ভারতীয় উপমহাদেশে যদি যুদ্ধ শুরু হয়েই যায়, তবে এ অঞ্চলের ভবিষ্যত একেবারেই অন্ধকার হয়ে যাবে। প্রতিবেশী দু’টি দেশ যদি কম করেও ১০০টি পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে (যা দুই দেশের মোট পরমাণু অস্ত্রের অর্ধেক), তাহলে এই উপমহাদেশে দু’কোটি ১০ লক্ষেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারাবেন। গুরুতর জখম বা সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যাবেন কম করে আরও ৫০ লক্ষ মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোদস্তুর যুদ্ধ বাধলে দু’টি দেশেরই প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদ বড় ধরণের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। তিনটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই গবেষণা বলছে, মহাজাগতিক রশ্মি ও অতিবেগুনি রশ্মির মতো অত্যন্ত ক্ষতিকারক রশ্মিগুলির হাত থেকে আমাদের প্রতি মূহুর্তে বাঁচিয়ে রাখে পৃথিবীর ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকা যে ওজোন স্তর, তার অর্ধেকটাই ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে যাবে এই উপমহাদেশে দুই পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রের যুদ্ধে। এর ফলে বড় মাত্রার ভূমিকম্প, বন্যা, দাবানল ও অগ্ন্যুৎপাতের মতো সর্বগ্রাসী প্রাকৃতিক মহা-দুর্যোগের ঘটনাগুলি তো বেড়ে যাবেই, গোটা উপমহাদেশে অচিরেই নেমে আসবে পারমাণবিক শৈত্য। যার ফলে বর্ষার একেবারে দফারফা হয়ে যাবে। আর তার জেরে বিশ্বজুড়েই ক্ষতিগ্রস্ত হবে চাষবাস। লক্ষ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। ধুধু মরুভূমিতে পরণিত হবে সুবজের সমারোহ খ্যাত এশিয়া মাহাদেশ।
যুদ্ধ মানেই ব্যাপক প্রাণহানি, ধ্বংসযজ্ঞ ও বিভীষিকাময় পরিবেশ। যা কোনো শান্তিকামী মানুষের কাম্য নয়। জার্মান লেখক এরিখ মারিয়া রেমার্ক তাঁর যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘অল কোয়াইট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’- লেখেন- এক সৈনিক বাংকারে বসে আরেক সহযোদ্ধাকে জিজ্ঞেস করছে, ‘যুদ্ধ লাগে কেন?’ সহযোদ্ধা বলল, ‘এক রাজা আরেক রাজাকে অপমান করে; তাই যুদ্ধ লাগে।’ তখন সৈনিকটি বলল, ‘আমাকে তো কেউ অপমান করেনি। আমি কেন যুদ্ধ করব?’ সঠিক চিত্রটিই এঁকেছেন জার্মান ঔপন্যাসিক। আসলে কোন দেশের সৈনিকরাই যুদ্ধ চায় না। কারণ যুদ্ধে তাদের কোন স্বার্থ নেই। যুদ্ধ হয় রাজায় রাজায়। ঢাল-তলোয়ার এবং বন্দুক কামানের মত সৈনিকরাও যুদ্ধের সরঞ্জাম মাত্র। অস্ত্র ছাড়া যেমন যুদ্ধ হয় না, তেমনি সৈনিক ছাড়াও যুদ্ধ চলে না। তাই অস্ত্রের চাহিদা এবং সৈনিকের প্রয়োজন। যুদ্ধে প্রাণহীন অস্ত্রের কোন ক্ষতি নেই। সৈনিকের সমস্যা হল তার প্রাণ আছে। সে যখন প্রাণ হারায় তখন তার স্ত্রী বিধবা হয়, সন্তান এতীম হয়; পুত্রশোকে মা পাথর হয়। এককথায় একজন সৈনিকের মৃত্যুতে একটি পরিবার বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে হাজার হাজার সৈনিক এবং লাখ লাখ নিরপরাধ মানুষ নিহত হয় একটি যুদ্ধে। মুহূর্তেই মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় দুটি সমৃদ্ধ দেশ, আক্রান্ত হয় আশেপাশের ভূখন্ডও। অথচ যুদ্ধের সময়ও রাজাকে শিকারভ্রমণে হতে দেখা যায়। কারণ যুদ্ধ পরিচালনার জন্য নাকি ‘প্রফুল্ল মন’ প্রয়োজন!
লেখক: বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক