৪১তম স্প্যান স্থাপনের মধ্য দিয়ে প্রমত্ত পদ্মার বুকে পূর্ণ অবয়ব পেল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। গতকাল বেলা ১২টা ০২ মিনিটে সেতুর মাওয়া প্রান্তের ১২ ও ১৩ নম্বর পিয়ারের ওপর বসানো হলো শেষ স্প্যানটি। এর মধ্য দিয়ে ৬.১৫ কিলোমিটার পূর্ণাঙ্গ সেতু দৃশ্যমান হলো আর রাজধানীর সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সরাসরি সড়ক সংযোগ তৈরি হলো। পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান স্থাপনের মুহূর্ত ছিল বাংলাদেশের জন্য এক মাহেন্দ্রক্ষণ। কারণ, এ পদ্মা সেতু নিয়ে কম জল ঘোলা করেনি বিশ্বব্যাংক। সম্ভাব্য দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন নিয়ে নানা টালবাহানা শুরু করেছিল তারা। অথচ দেশ এবং দেশের বাইরের কোনো আদালতেই বিশ্বব্যাংকের সেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
কিন্তু প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল গোটা দেশ, দেশের উন্নয়নকে এবং রুদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল একটি বহুলাকাক্সিক্ষত স্বপ্নকে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞাপূর্ণ সিদ্ধান্তে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রত্যাখ্যান করে নিজস্ব অর্থায়নে শুরু হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ। প্রধানমন্ত্রীর এমন সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছিল দেশের আপামর জনসাধারণ। বিশ্বমোড়ল বিশ্বব্যাংকের খবরদারিকে তুচ্ছ করে নিজস্ব অর্থায়নে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে চলেছে; যা দেশের মানুষকে আরেকবার স্ব-মর্যাদার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পদ্মা বহুমুখী সেতুর পূর্ণ অবয়ব প্রাপ্তির আনন্দ বইছে সারা দেশে। এর শেষ স্প্যান বসানোর মুহূর্তে উচ্ছ্বসিত-গর্বিত হয়ে ওঠেছেন এই সেতুতে কর্মরত সকল প্রকৌশলী ও কর্মী এবং কর্মচারীরা। সেই সঙ্গে সারা দেশে উদ্বেলিত এমন মুহূর্তকে জয় করার আনন্দে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে জাতি যেন আরও একটি বিজয় অর্জন করল। এ বিজয় কুচক্রি, ষড়যন্ত্রকারী, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির বিরুদ্ধে। এর সব কৃতিত্বই মানুষ দিতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান স্থাপনের এ ঘটনাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানাভাবে তুলে ধরেছেন সাধারণ মানুষ।
এ প্রজন্মের লেখক ও অ্যাক্টিভিস্ট মারুফ রসূল পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান স্থাপনের মুহূর্তকে স্মরণীয় মনে করেন নানা কারণে। তিনি বলেন, আমার কাছে ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়ানো বাংলাদেশের সক্ষমতার এক অনিন্দ্য স্মারক হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু। মুক্তিযুদ্ধের পর একটি সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রকে নিয়ে তৎকালীন দাতাগোষ্ঠী যে জঘন্য রাজনৈতিক খেলায় মেতেছিলো, বাংলাদেশ আজ তার একটি পাল্টা জবাব প্রতিষ্ঠা করলো। তিনি লেখেন, অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড ও জে আর পারকিনসনের একটি বই আছে ইধহমষধফবংয : ঞযব ঞবংঃ ঈধংব ড়ভ উবাবষড়ঢ়সবহঃ নামে। ১৯৭৭ সালে লেখা এই বইটিতে ব্যাপক গবেষণার পর বাংলাদেশকে ব্যঙ্গ করে তারা লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশ যদি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সফল হতে পারে, তাহলে পৃথিবীর যে কোনো দেশই তা পারবে’ (পৃ. ১৯৭)। এমন তামাশা তখন অনেকেই করেছিলেন।
কিসিঞ্জারের ‘তলাহীন ঝুড়ির’ কথা কে না জানে? ১৯৭৪ সালে সদ্য স্বাধীন হওয়া রাষ্ট্রের জনগণের জীবন নিয়ে আন্তর্জাতিক দাতাগোষ্ঠীগুলোর অপরাজনীতির নজির তাদের সে সময়ের প্রতিবেদনগুলোর পরতে পরতে সাজানো আছে। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের ষড়যন্ত্রের সংবাদগুলো আমরা অনেকেই জানি; কীভাবে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমাদের দেশীয় এজেন্ট ও কতিপয় গণমাধ্যম জড়িয়েছে তা কারও অজানা নয়।’ তিনি আরো লেখেন, ‘১৯৭৪ সালে মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য অটো পাসম্যান ছিলেন বিদেশী সাহায্যের বিষয়ে নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তি। বাংলাদেশকে খাদ্য সাহায্য দেবার বিষয়ে তিনি তখন একটি শর্ত দিয়েছিলেন। প্রতিযোগিতামূলক বাছাই প্রক্রিয়া ছাড়াই তার সুপারিশ মতো শিপিং এজেন্ট নিযুক্ত করতে হবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে খাদ্য পরিবহনের জন্য। বিনিময়ে তিনি খাদ্য সাহায্যের বিষয়টি দেখবেন। কিন্তু বাংলাদেশ দূতাবাস প্রচলিত বিধি অনুযায়ী সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক অথবা কম খরচের শিপারকে নিযুক্ত করতে চেয়েছিলো। এ কথা বাংলাদেশের পরিকল্পনা কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম তার স্মৃতিকথাতে লিখেছেনÑবিশ্বব্যাংক বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় গৃহীত বেশ কিছু পদক্ষেপের সমালোচনা করেছিলো। তাদের শর্ত ছিলো পদক্ষেপগুলো বাতিল করতে হবে। যেমন : আমলাতন্ত্রের ব্যয় সংকোচন করেছিলো বঙ্গবন্ধু সরকার, বিশ্বব্যাংক তা বৃদ্ধির শর্ত দিলো; রেশন পদ্ধতিতে বণ্টনকৃত খাদ্যশস্যের দাম বৃদ্ধি ও সারে ভর্তুকি হ্রাসের জন্য বিশ্বব্যাংক চাপ দিতে লাগলো। বঙ্গবন্ধু সরকার এসব শর্ত মেনে নেয়নি, তবে পঁচাত্তর পরবর্তী সব সরকারই বিশ্বব্যাংকের এই শর্তগুলো একে একে মেনে নিয়েছে। এভাবেই বিদেশি দাতাগোষ্ঠী আর রাষ্ট্রগুলো তখন বাংলাদেশের নবগঠিত অর্থনীতি নিয়ে একের পর এক ষড়যন্ত্র চালিয়েছে। বাংলাদেশের তৎকালীন কিছু গণমাধ্যমও তার সঙ্গে জুড়েছিলো। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনের প্রসেডিংসে কমরেড ভূপেশ গুপ্তের আলোচনাটি পড়লে ৫ জন সাংবাদিক কাম সিআইএ’র এজেন্টের নাম পাওয়া যায়। নামগুলো না হয় আরেকদিনের জন্য তোলা থাকলো।
বিশ্ব ব্যাংকের রাজনীতিকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে সম্পূর্ণ পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান হয়েছে। যে গণমাধ্যমগুলো এই তিন-সাড়ে তিন বছর আগেও ‘গেলো গেলো’ রব তুলেছিলো, তারাই এখন ‘হলো হলো’ রব দিচ্ছেন। গত ৫০ বছর ধরে এদেশের কাঠমোল্লারা ফতোয়া দিয়েছে ‘নারী নেতৃত্ব হারাম’; আজ নারী নেতৃত্বেই পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে, অন্য এক উচ্চতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশ। ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৫০ বছর আগে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।’ ৫০ বছরের বাংলাদেশে আজ আমাদের অনুভব আমরা যখন বাঁচতে শিখেছি, তখন শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করেই আমরা বেঁচে থাকবো।’ ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়ই পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তা শুরু হতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় ফিরে পুনরায় পদ্মা সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। প্রকল্পে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব নিয়ে আসে বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু বনিবনা না হওয়ায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবায়ন বিলম্বিত হতে থাকে। ২০১০ সালের জুলাইয়ে সেতু নির্মাণের জন্য প্রাক- যোগ্যতা দরপত্র মূল্যায়ন করে পাঁচ দরদাতাকে বাছাই করে তা বিশ্ব ব্যাংকের অনাপত্তির জন্য পাঠানো হলেও সংস্থাটি তা ঝুলিয়ে রাখে। এরপর পদ্মা সেতুতে ‘সম্ভাব্য দুর্নীতির’ অভিযোগ আনে বিশ্ব ব্যাংক। দীর্ঘ টানাপোড়েন শেষে বাংলাদেশ বিশ্ব ব্যাংককে ‘না’ বলে দেয়। সেই টানাপোড়েনে একজন মন্ত্রীকে সরে যেতে হয়, তখনকার সেতু সচিবকে দুদকের মামলায় কারাগারেও যেতে হয়। অভিযোগের সত্যতা না থাকায় সেই মামলায় পরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় দুদক। কানাডার আদালতেও দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
শেষ পর্যন্ত নকশা অপরিবর্তিত রেখে নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শুরু হয় সেই বিপুল কর্মযজ্ঞ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদী শাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় প্রথম স্প্যান। মোট ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু মাঝে ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া গেলে নকশা সংশোধনের প্রয়োজন হয়। পরে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। তাতে বাড়তি সময় লেগে যায় প্রায় এক বছর। এরপর করোনাভাইরাস মহামারি আর বন্যার মধ্যে কাজের গতি কমে যায়। সব বাধা পেরিয়ে অক্টোবরে বসানো হয় ৩২তম স্প্যান। এরপর বাকি স্প্যানগুলো বসানো হয়ে যায় অল্প সময়ের মধ্যেই। মূল সেতু নির্মাণের কাজটি করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) ও নদীশাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি কোম্পানি সিনোহাইড্রো করপোরেশন। দুটি সংযোগ সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ করেছে বাংলাদেশের আবদুল মোমেন লিমিটেড।
সিনোহাইড্রো করপোরেশনই পদ্মা সেতুর জন্য নদী শাসনের কাজ করছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত সে কাজের ৭৬ শতাংশ শেষ হয়েছে। সব মিলিয়ে নভেম্বর পর্যন্ত পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ৮২ দশমিক ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছিল। ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। তাতে মোট দেশজ উৎপাদন এক দশমিক দুই শতাংশ বাড়বে এবং প্রতি বছর শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ হারে দারিদ্র্য কমবে বলে সরকার আশা করছে।
যেভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু :বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য পদ্মা সেতু হচ্ছে ইতিহাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প। দুই স্তর বিশিষ্ট স্টিল ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাস ব্রিজটির ওপরের স্তরে রয়েছে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরটিতে রয়েছে একটি একক রেলপথ। পদ্মা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর আববাহিকায় ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যর ৪১টি স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য এবং ১৮ দশমিক ১০ মিটার প্রস্থ পরিকল্পনায় নির্মিত হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় এই সেতু। এটির জন্য প্রয়োজনীয় এবং অধিগ্রহণকৃত মোট জমির পরিমাণ ৯১৮ হেক্টর। ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু। সেতুর ওপরের অংশে যানবাহন ও নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। মূল সেতু নির্মাণের জন্য কাজ করছে চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (এমবিইসি) ও নদী শাসনের কাজ করছে দেশটির আরেকটি প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন।
পদে পদে বাধা :বাঙালির এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রথমভাগেই বাধা এসে সব কাজকে পয়মাল করে দিতে চেয়েছে। পদ্মা সেতুতে বিশ^ব্যাংক তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। কেন তারা চুক্তি ভঙ্গ করলো প্রথম দিকে সে বিষয়টি গোপন রাখে। তাদের এই সিদ্ধান্ত ক্রমান্বয়ে ডালা পালা মেলে দেশজুড়ে বিতর্কের জন্ম দেয়। আওয়ামী বিরোধী রাজনৈতিক দল এটিকে অস্ত্র হিসাবে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ইচ্ছেমত অভিযোগ তোলে। যেখানে বলা হয়, দুর্নীতির গন্ধ পেয়ে বিশ^ব্যাংক এই প্রকল্প থেকে তাদের প্রতিশ্রুত অর্থ ছাড় না দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এসময় তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের দিকে তাক করা হয় অভিযোগের তীর। যদিও প্রথম দিকে বিশ^ব্যাংক তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কোন কারণ জানায়নি। তারপরেও দেশে এই অভিযোগ উঠায় তারা নিজেদের রক্ষায় মওকা খুঁজে পায়। পিঠ বাঁচাতে বিশ^ব্যাংক কানাডার এক আদালতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সেতু নিয়ে দুর্নীতির মামলা দায়ের করে। আদালতও নড়ে চড়ে বসে। তারা বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়ে তদন্তে নামে। এসময় বিশ^ব্যাংকের দায়িত্বশীলরা যেমন তদন্তে উৎসাহ দেখান, তেমনি তাদেরকে সরকার বিরোধী একটি মহল বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। এসময় বেশ কয়েকটি মিডিয়া বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধী ভূমিকায় নামে। এমনকি সরকার এবং তার মন্ত্রীদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। কোন রকম প্রমাণ ছাড়াই তারা বলতে এবং লিখতে শুরু করে দুর্নীতির গন্ধ পেয়েই বিশ^ব্যাংক এই প্রকল্প থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছে। কেবল বিশ^ব্যাংক নয় সে সময় জাইকাও এই প্রকল্পে তাদের অনুদান স্থগিত করে। সব মিলিয়ে সময়টি সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জের ছিল। তবে হিমালয়ের মত স্থির ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি কেবলমাত্র বলেন, কেউ না এলেও বাংলাদেশ তার অভ্যন্তরীণ আয় থেকেই এই সেতু নির্মাণ করবে। যা শুরুর কথা আমরা চিন্তা করেছি বিশে^ কোন শক্তি নেই সেখান থেকে আমাদের বিচ্যুত করে। এই যে প্রধানমন্ত্রী নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের শপথ নিলেন তারাই সফল পরিসমাপ্তি ঘটেছে গতকাল। সেতুতে ব্যবহৃত ৪১ টি স্প্যানের সর্বশেষটি বসানোর ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে।
এভাবেই শুরু হয় পদ্মা সেতু নির্মাণের মহাযজ্ঞ। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ও নানামুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সেতুর সব স্প্যান বসানো শেষ হতে তিন বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। গতকাল শেষ স্প্যান বসানো নিয়ে দুই দিন ধরে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন পদ্মা সেতুর প্রকৌশলী ও কর্মীরা। এত বিশাল ও জটিল একটি কাজ ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করতে পারায় এ কাজে নিয়োজিত সবাই গর্বিত বোধ করছেন। শেষ স্প্যান বসানোর এই ব্যস্ততম দিনে গণমাধ্যমে তারা নিজেদের প্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন। প্রকাশ করেছেন নিজেদের অনুভূতি। শেষ স্প্যান বসানোর মুহূর্তটিকে স্মরণীয় করে রাখতে গর্বিত প্রকৌশলী ও কর্মীরা শেষ স্প্যানের সঙ্গে নিজেদের ছবি তুলে রেখেছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার পদ্মা সেতু এলাকায় এমন দৃশ্যই চোখে পড়েছে। এবিষয়ে কথা হয় পদ্মা সেতুর উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে। নিজের আবেগ অনেক কষ্টে চেপে রেখে তিনি বলেন, ‘প্রথম থেকেই পদ্মা সেতুর কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। আজ (গতকাল) শেষ স্প্যান বসানোর দিন নিজেকে নিয়ে খুব গর্বিত বোধ করছি। সেতুর কাজে নিজেকে এমনভাবে জড়িয়ে ফেলেছি যে যেদিন নদী ভাঙনে কন্সট্রাকশন ইয়ার্ডের কিছু অংশ পানিতে তলিয়ে গেলো সেদিন বুক ফেটে কান্না চলে এসেছে।’
আরেক সহকারী প্রকৌশলী আহসান উল্লাহ মজুমদার শাওন বলেন, ‘এই রকম বিশাল এক প্রকল্পে নিজেকে যুক্ত রাখতে পেরে অনেক ভাগ্যবান মনে করছি। আজ সর্বশেষ স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ধাপ শেষ হলো। এখন দ্রুত গতিতে চলবে রোডওয়ে ও রেলওয়ে স্ল্যাব বসানোর কাজ।‘
সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী (মূল সেতু) দেওয়ান মো. আব্দুল কাদের যা বললেন। ‘এই প্রকল্প এত বিশাল ও বড় যে দুই এক কথায় এই প্রকল্প সম্পর্কে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। তবে একটি কথা বলি। সেটি হলো, এই সেতুর কাজে প্রথম থেকে যুক্ত থেকে নিজেকে অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ করতে পেরেছি। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছে।’
কাজের অগ্রগতি আর খরচের খতিয়ান : গত ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত মূল সেতুর বাস্তব কাজের অগ্রগতি ৯১ ভাগ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৮৮ দশমিক ৩৮ ভাগ। মূল সেতু কাজের চুক্তিমূল্য ১২ হাজার ১৩৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৭২৩ দশমিক ৬৩ কোটি টাকা। নদীশাসন কাজের বাস্তব অগ্রগতি ৭৫ দশমিক ৫০ ভাগ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৬৫ দশমিক ১৭ ভাগ। নদীশাসন কাজের চুক্তিমূল্য ৮ হাজার ৭০৭ দশমিক ৮১ কোটি টাকা এবং এ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৫ হাজার ৬৭৪ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা। সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ শেষ হয়েছে অনেক আগেই। সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার খাত, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ খাত, পরামর্শক, সেনা নিরাপত্তা, ভ্যাট ও আয়কর, যানবাহন, বেতন ও ভাতাদি এবং অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ ৭ হাজার ৭১৬ দশমিক ৯১ কোটি টাকা। প্রকল্পের সর্বমোট বাজেট ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ২৪ হাজার ১১৫ দশমিক ০২ কোটি টাকা; অর্থাৎ ৭৯ দশমিক ৮৯ ভাগ। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি ৮২ দশমিক ৫০ ভাগ।
দাতা গোষ্ঠি সেতু নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থের প্রতিশ্রুতি দেয়। তাদের প্রতিশ্রুতির উপর ভিত্তি করে শেখ হাসিনার সরকার সেতুর ডিজাইনসহ মূল কাজের নকশা চুড়ান্ত করে। কিন্তু হঠাৎই কালোমেঘে ঢেকে যায় বাঙালির এই স্বপ্ন। মন খারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে, মত দাতা গোষ্ঠি মিথ্যা অভিযোগ করে বসে। তাদের এমন অভিযোগ যা ছিল সরকার দেশএবং মানুষের জন্য অপমানকর। বিশ^ব্যাংক হঠাৎ করেই প্রকল্প প্রস্তুতির সঙ্গে যুক্ত কিছু লোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তার প্রতিশ্রুতি প্রত্যাহার করে নেয়। অন্যান্য দাতাও সেটি অনুসরণ করে। পবর্তীতে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই ঘটনায় তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এমনকি জেল যেতে হয় সচিব মোশাররফ হোসেন ভূইয়াকে। যখন দুর্নীতির প্রমাণ করা গেল না তখন কানাডিয়ান আদালত মামলাটি বাতিল করে দেয়। একই সঙ্গে আদালত অভিযোগ উত্থাপনকারীদের বিরুদ্ধে অসন্তোষ প্রকাশ করে। তবে প্রকারন্তে বাংলাদেশের উপকারই হয়েছে। ঋণের টাকা বয়ে নিয়ে বেড়ানোর লজ্জা থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পেয়েছে। শেখ হাসিনার সরকরে নিজস্ব সম্পদ থেকে অর্থায়ন করে এই মহাযজ্ঞ সফলতার সঙ্গে শেষ করেছেন। এই ঘটনার ভিতর দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো বাঙালি বীরের জাতি। তারা অন্যের সাহয্যের চেয়ে নিজেদের পেশির উপর বেশি আস্থাশীল। তবে এই সেতু নির্মাণে বাঙালির আশাকে বাস্তবায়ন করতে শেখ হাসিনার নাম স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ থাকবে। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরের প্রজন্ম এভাবেই বিষয়টি মূল্যায়ন করবেন। সেই কথাটি বড় আস্থার সঙ্গে বললেন বিশিষ্ট সাংবাদিক রহমান মফিজ। ‘আমাদের আগামী প্রজন্ম এই কাজটিকে দেখবে বিস্ময়ের চোখে। আমরা যেমন তিনশ বছর আগের তাজমহল নিয়ে এখন অবাক হই, তেমনি সেদিন আগামী প্রজন্ম অবাক হবে- সত্যি সত্যি আমাদের দেশে এমন একজন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, যিনি সব চড়াই উতরিয়ে এমন নজির সৃষ্টি করেছেন।’