প্রকাশ: শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:৫৯ পিএম আপডেট: ১১.১২.২০২০ ৭:০৭ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের একাদশ দিন আজ। ১৯৭১ সালে ক্যালেন্ডারের পাতায় এদিনটি ছিল শনিবার। মুক্তিপাগল বাংলার মানুষ একটু একটু করে এগুতে থাকে বিজয়ের পথে। এদিনের তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল টাঙ্গাইল শহরের মুক্তি অর্জন, যার মধ্য দিয়ে ঢাকা শহর মুক্ত করার পথ খুলে গিয়েছিল। ঢাকায় বেলা ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য জারি করা হয় সান্ধ্য আইন। জাতিসংঘের অনুরোধে ঢাকায় থাকা বিদেশি নাগরিকদের স্থানান্তরের জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে সাময়িক সময়ের জন্য বিমান হামলা স্থগিত করা হয়। যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজয় অনিবার্য জেনেও লে. জেনারেল নিয়াজি ঢাকা বিমান বন্দর পরিদর্শন করতে গিয়ে দম্ভভরে বলেন, কোনক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেওয়া চলবে না। এদিকে যৌথবাহিনী দেশের বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রাখে। হিলি সীমান্তে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর চলে তুমুল লড়াই। সন্ধ্যায় সম্মিলিত বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে চালায় সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়।
সারারাত যুদ্ধের পর ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী। এদিন শত্রুমুক্ত হয় জামালপুর, যশোর, মুন্সিগঞ্জ, লাকসাম, আশুগঞ্জ, টাঙ্গাইল, দিনাজপুরের হিলিসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা। টাঙ্গাইলের মধুপুর অঞ্চলে অবতরণ করে মিত্র বাহিনীর ৭০০ সৈন্য। তীব্র যুদ্ধ হয় পাকব্রিগেডের সঙ্গে। মুক্ত যশোরের জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এগুলো হলো: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের আগের মালিককে সম্পত্তি ফেরত দান, সব নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং চারটি রাজনৈতিক দল (জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামী ইসলামী) নিষিদ্ধকরণ। এক সংবাদ সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউসে তারা আরো বলেন, তারা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করবেন যা ২৪ বছরে করতে পারেনি পাকিস্তান। এদিকে মেজর জেনারেল রাও ফারমান আলী খানের মাধ্যমে ডা. মালিকের প্রস্তাব পেশ করা হয় ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে। সাংবাদিক ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এক রিপোর্টে উল্লেখ করেন যে, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে পাঁচটি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানান। শর্তগুলো হচ্ছে:পাকিস্তানি বাহিনী ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে, বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তারা কোন লিখিত চুক্তি করবে না, পশ্চিম পাকিস্তানের এক লাখ নাগরিককে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত যেতে দিতে হবে, এরপর পাকিস্তানি সৈন্যদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে দিতে হবে, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে হবে। কিন্তু এ প্রস্তাব নাকচ করেন ইয়াহিয়া খান। বরং তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে দাবি জানান পাকিস্তানকে যুদ্ধ সহায়তার জন্যে। কিন্তু এ বিষয়ে নিশ্চুপ থাকলেও প্রেসিডেন্ট নিক্সন, যুক্তরাষ্ট্র জোর দাবি জানায় জাতিসংঘে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য।
ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার রাশিয়ার প্রতিনিধি ভোরেন্টসভকে হুঁশিয়ার করে বলেন, ১২ ডিসেম্বর মধ্যাহ্নের আগে ভারতকে অবশ্যই যুদ্ধ বিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে। অন্যথায় যুক্তরাষ্ট্র নিজেই প্রয়োজনীয় সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের এমন হুঁশিয়ারি সামান্যতম মনোবল ভাঙতে পারেনি যৌথবাহিনীর। পরাজয়ের ভয়ে পাকদোসর রাজাকার, আল বদর, আল শামস চালাতে থাকে গুপ্ত হত্যা। বুদ্ধিজীবীদের খুঁজে খুঁজে নিশ্চিহ্ন করতে থাকে তারা। সেই গুপ্তহত্যার শিকার হন দৈনিক পত্রিকা পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন সাংবাদিক আবু নাসের মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা। ভোরবেলা তাকে বাড়ি থেকে লোক পাঠিয়ে তুলে নিয়ে যায় একই পত্রিকার প্রতিবেদক রাজাকার চৌধুরী মুঈনুদ্দীন। বহু শহীদের আত্মত্যাগের বিনিয়ে বিজয়ের সন্নিকটে যেতে থাকে দেশ। মুক্তিসেনাদের জয় বাংলা সেøাগানে আর বিজয় মিছিলে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে চারদিক। আনন্দ-উল্লাসের পাশাপাশি শুরু হয় হারানো স্বজনদের খোঁজার পালা।
তথ্যসূত্রঃ স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মূলধারা’৭১, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর