১৯৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এই বাংলার প্রতিটি কোনায় কোনায় রক্তপাত ঘটিয়েছে। সীমান্তের নিকটবর্তী হোক আর দূরবর্তী হোক, যাতায়াত সহজ হোক আর কঠিন হোক, পাক হানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়েছে সর্বত্র, নির্বিচারে। সরকারি স্থাপনাগুলোকে তারা গড়ে তুলতো টর্চার সেল হিসেবে। তৎকালীন বরিশাল জেলাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
পাকিস্তানি বাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল বরিশাল শহর দখল নিয়ে প্রথমে অশ্বিনী কুমার টাউন হল ও বরিশাল জেলা স্কুলে সাময়িক অবস্থান করে। পরবর্তী সময়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ওয়াপদা অফিসে তাদের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে। ওয়াপদা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস বরিশাল সিটি করপোরেশনের ১২ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। ত্রিশ গোডাউন ও ওয়াপদা ছিল পাশাপাশি অবস্থিত। ওয়াপদার পূর্বদিক দিয়ে প্রবহমান কীর্তনখোলা নদী এবং দক্ষিণ পাশে সাগরদি খাল, এই খালটি শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। খালের ওপর রয়েছে একটি পরিত্যক্ত ব্রিজ। জনবসতিহীন খালেরপাড় ঘেঁষে ছিল ডোবা-নালা ও জরাজীর্ণ জলাভূমি। ওয়াপদা অফিসের পশ্চিম পার্শ্বে অবস্থিত সাগরদি বাজার। এখানে পাকিস্তানি সেনারা ভারী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে। স্থানটি তৎকালীন বরিশালবাসীর কাছে ক্যান্টনমেন্ট হিসেবে পরিচিতি পায়। ‘ওয়াপদা ক্যান্টনমেন্ট’ রক্ষার জন্য ৩ শতাধিক সশস্ত্র রাজাকার প্রহরী হিসেবে নিয়োজিত ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ওয়াপদায় অফিস, বাসস্থান, ব্যারাক ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে টর্চারসেল স্থাপন করেছিল। তারা স্থানীয় রাজাকার, আল-বদর, শান্তি কমিটির সহায়তায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ ধরে এনে সাগরদি খালের পরিত্যক্ত ব্রিজের ওপর দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করতো। এই গণহত্যার নেতৃত্ব দিয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্নেল আতিক মালিক, মেজর ইয়াহিয়া হামিদ, মেজর জামিল, ক্যাপ্টেন কাহার, ক্যাপ্টেন এজাজ। বরিশালের বিভিন্ন স্থানে সামরিক অপারেশনের আগে এই অফিসে বৈঠক হতো। পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সংলগ্ন খালে থাকতো স্পিডবোট। পাশে কীর্তনখোলার তীরে সার্বক্ষণিক থাকতো গানবোট। স্থানটিকে সুরক্ষিত করার জন্য তারা এখানে দেয়াল উঁচু করে চারদিকে ডজনেরও বেশি সুরক্ষিত বাঙ্কার তৈরি করে।
২ মে থেকে শুরু হয়ে ৮ ডিসেম্বর বরিশাল হানাদারমুক্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী এখানে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণ, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করে। তারা প্রায় ৩ হাজার সাধারণ মানুষকে এখানে নির্মমভাবে হত্যা করে বলে ধারণা করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ওয়াপদা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ত্রিশ গোডাউন সংলগ্ন এলাকায়ও নিরীহ মানুষকে ধরে এনে নির্যাতন করতো। খাদ্যগুদামের আশপাশে বিশেষ করে দিঘির চারপাশে লাশ ও মানুষের ছিন্নভিন্ন দেহাবশেষ পড়ে ছিল দীর্ঘদিন।
প্রত্যক্ষদর্শী মুক্তিযোদ্ধা এনায়েত চৌধুরীর মতে, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী স্টিমার ও লঞ্চে বরিশাল থেকে ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এখানে প্রতিদিন ১০-১৫ জন মানুষকে হত্যা করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগীরা ওয়াপদা কলোনিতে প্রায় ২২৪ দিন অবস্থান করে। যদি একদিন পরপরও গণহত্যা সংঘটিত করে, তবে গণহত্যার সংখ্যা দাঁড়ায় সহস্রাধিক। ওয়াপদা মুক্ত হবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের যে দলটি প্রথমে ওয়াপদার ভেতরে প্রবেশ করে তার মধ্যে অন্যতম ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ। বাঙ্কারের মধ্যে তারা কয়েকজন নারীর মৃতদেহ পায়। ওয়াপদা গণহত্যায় মুজিবুর রহমান কাঞ্চন (৪৬) (পিতা আহসান উদ্দীন আহমেদ, বিএম স্কুল রোড, বরিশাল), কাজী আজিজুল ইসলাম (৪১) (পিতা কাজী আমিনুল ইসলাম, এডিসি, বরিশাল; চিওড়া, কুমিল্লা), এস এম আলমগীর (২৩) (পিতা এস এম এস্কান্দার আলী, ছাত্র, আলেকান্দা, বরিশাল) সহ ১৬ জন শহীদের নাম জানা যায়।
ওয়াপদা গণহত্যা-নির্যাতনে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিলো সরদার গোলাম কুদুস (কালি বাড়ি রোড, বরিশাল), মো. আমজাদ হোসেন (কাশীপুর, বরিশাল), খলিলুর রহমান (ফকির বাড়ি রোড, বরিশাল), আবদুর রব (বিএম স্কুল রোড, বরিশাল), শাহজাহান চৌধুরী (পিতা ইসমাইল চৌধুরী, সদর রোড, বরিশাল), নুরুল ইসলাম শিকদার (বগুড়া রোড, বরিশাল), মওলানা শাহ আবু জাফর (বানারীপাড়া, বরিশাল), বশির উল্লাহ আতাহারী (গির্জা মহল্লা, বরিশাল), আবদুল মজিদ (নাজিরের পুল, বরিশাল), মতি তালুকদার (নতুন বাজার, বরিশাল), হাদিস (ব্রাউন্ড কম্পাউন্ড, বরিশাল) প্রমুখ। ওয়াপদা গণহত্যা ও বধ্যভূমির কথা দীর্ঘদিন অনেকের অজানা ছিল। বর্তমান সরকার এই গণহত্যা ও বধ্যভূমির স্মৃতিরক্ষায় স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বরিশাল জেলার গণহত্যা নিয়ে সবিস্তর জরিপ করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ পরিদর্শক ডক্টর মনিরুজ্জামান শাহীন। তার জরিপে বরিশাল জেলার গণহত্যাগুলো নতুনভাবে উঠে এসেছে। তিনি দেখিয়েছেন শুধু বরিশাল জেলায় বধ্যভূমি, গণকবর, গণহত্যা এবং নির্যাতন কেন্দ্রের মোট সংখ্যা ৩০৬টি যেখানে পূর্বতন গবেষণাগুলোতে মনে করা হতো এই সংখ্যা মাত্র ৮টি।