প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:০৭ এএম আপডেট: ০৮.১২.২০২০ ২:১৭ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
করোনাভাইরাস থেকে বিশ^বাসীকে নিষ্কৃতি দিতে করোনার টিকা বাজারে আসার খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছে বিশ^বাসী। এরই মধ্যে রাশিয়া তাদের নিজস্ব উৎপাদিত টিকা স্পুটনিক-৫ তাদের দেশের মানুষের ভেতরে ব্যাপক আকারে পুশ করা শুরু করেছে। করোনা প্রতিরোধে ফাইজার ও বায়োএনটেক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে তৈরি কোভিড ভ্যাকসিন জরুরি অবস্থায় বিক্রির উদ্দেশে সাময়িক অনুমোদন দেয় যুক্তরাজ্য। করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ৯৫ শতাংশ সাফল্যের দাবিদার এই টিকাকে ব্যবহারের জন্য নিরাপদ ঘোষণা করেছে যুক্তরাজ্যের মেডিসিনস অ্যান্ড হেলথ কেয়ার প্রোডাক্টস রেগুলেটরি এজেন্সি। যুক্তরাজ্য নিজ দেশের নাগরিকদের করোনামুক্ত রাখতে টিকা ব্যবহারের কার্যক্রম শুরু করেছে। ফাইজার বায়োটেকের তৈরি এই টিকা প্রথমধাপে করোনার সম্মুখ যোদ্ধা এবং বয়স্কদের ভেতরে প্রয়োগ করার কর্মসূচি নিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ছাড়পত্র পাওয়ার পর গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাজ্যে পৌঁছায় মার্কিন ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ফাইজারের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা। এরপর থেকেই অপেক্ষার প্রহর শুরু হয়। টিকাদান কর্মসূচির বিষয়ে দেশটির স্বাস্থ্য বিভাগ ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) জানায় গতকাল থেকেই সফলভাবে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। এবিষয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল ডিরেক্টর প্রফেসর স্টিফেন পোয়িস জানান, টিকাদান কর্মসূচির মাধ্যমে করোনা মহামারির সমাপ্তি হতে যাচ্ছে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কম সময়েই এই কর্মসূচি শেষ হবে না বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। স্টিফেন বলেন, যাদের এই টিকা প্রয়োজন তাদের সবাইকে টিকা দিতে কয়েকমাস সময় লেগে যেতে পারে। করোনার সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে স্বাস্থ্যকর্মী, ৮০ বছরের বেশি বয়সী লোকজন ও কেয়ারহোমের কর্মীরা সবার আগে করোনার টিকা পাবেন। ইংল্যান্ডে টিকা দেওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে ৫০টি হাসপাতাল নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্কটল্যান্ড, ওয়েলস এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডেও বিভিন্ন হাসপাতালে টিকাদান কর্মসূচির বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ট্রায়ালে করোনা টিকা নিয়ে ভারতের এক রাজ্য মন্ত্রীর করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। যা করোনা টিকার কার্যকারিতা বিষয়ে অনেকটাই সন্দেহ সৃষ্টি করেছে। এদিকে যুক্তরাজ্য ও বাহরাইনে অনুমোদন পাওয়ার ভারতেও নিজেদের তৈরি কোভিড টিকা বিক্রির অনুমোদন চেয়েছে ফাইজার ইন্ডিয়া। ভারতের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেলের (ডিজিসিআই) কাছে এ আবেদন করা হয়েছে। গত রোববার ভারতীয় সংবাদমাধ্যম হিন্দুস্তান টাইমস জানিয়েছে, ২০১৯ সালের নতুন ওষুধ ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল আইন অনুযায়ী ভারতে তাদের কোভিড টিকা আমদানি, সরবরাহ ও বিক্রির অনুমোদন চেয়ে গত ৪ ডিসেম্বর আবেদন জানিয়েছে ফাইজার। এদিকে টিকা সংরক্ষণের বিষয়ে নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। ফাইজারের তৈরি কোভিড টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়। কিন্তু ভারতের ছোট শহর ও গ্রামাঞ্চলে তার ব্যবস্থা কতটা করা সম্ভব, সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে দেশটির চিকিৎসক ও প্রশাসনিক মহলে। ফাইজারের তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, ‘এই মহামারি পরিস্থিতিতে শুধু সরকারি চুক্তি মোতাবেক, সরকারি নির্দেশিকা মেনে প্রশাসনিক পরিকাঠামোর মাধ্যমে ভ্যাকসিন সরবরাহে আগ্রহী ফাইজার।’
বর্তমানে ভারতে মোট পাঁচটি কোভিড টিকার ট্রায়াল চলছে। এর মধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি টিকার ট্রায়াল পরিচালনা করছে। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে দেশীয় প্রক্রিয়ায় তৈরি আইসিএমআর ও ভারত বায়োটেক সংস্থার ভ্যাকসিনের। জাইডাস ক্যাডিলা সংস্থার ভ্যাকসিনের তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালের অনুমোদন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। তবে জট পাকিয়েছে টিকা নেওয়ার পরও হরিয়ানার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর করোনায় আক্রান্ত নিয়ে। দেশটির বায়োটেকের উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা কোভ্যাকসিন গ্রহণ করার পরও আক্রান্ত হয়েছেন হরিয়ানা রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজ। আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে আম্বালার একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টুইটারে নিজেই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিনি। ভারতে কোভ্যাকসিন টিকার তৃতীয় বা চূড়ান্ত পর্বের ট্রায়াল চলছে। এই পর্বে টিকা দেওয়া হবে ২৬ হাজার মানুষকে। কোভ্যাকসিন টিকার তৃতীয় পর্বের ট্রায়াল শুরু হতেই প্রথম টিকার ডোজ নিয়েছিলেন আলিগড় মুসলিম বিদ্যালয়ের উপাচার্য তারিক মনসুর। আইসিএমআর জানিয়েছে, কোভ্যাকসিন টিকার ট্রায়ালে অংশ নিতে কমিটি তৈরি করা হয়েছে। টিকার পরীক্ষার জন্য এগিয়ে আসতে আবেদন করা হয়েছে চিকিৎসক, আইনজীবী, সমাজকর্মী থেকে সমাজের সব পেশার মানুষজনকেই। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে টিকার ট্রায়াল ডোজ নেন হরিয়ানার স্বাস্থ্যমন্ত্রীও। কিন্তু ১৫ দিনের মধ্যেই আক্রান্ত হলেন তিনি। টুইটারে অনিল ভিজ লিখেছেন, ‘আমি করোনা আক্রান্ত হয়েছি। আম্বালা ক্যান্টনমেন্টের সিভিল হাসপাতালে ভর্তি রয়েছি। যারা আমার সংস্পর্শে এসেছেন তাদের কোভিড টেস্ট করিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। এর আগে ১৯ নভেম্বর টুইট করে ৬৭ বছরের অনিল ভিজ বলেছিলেন, ২০ নভেম্বর ১১টার সময় আম্বালা ক্যান্টনমেন্টের সিভিল হাসপাতালে ভারত বায়োটেকের করোনাভাইরাসের টিকার ট্রায়াল ডোজ নেব আমি। পিজিআই রোহতক ও স্বাস্থ্য দফতরের চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে হবে এই টিকার ট্রায়াল। ঘোষণামতো টিকা নেন তিনি। সেই টিকার ট্রায়ালের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছিল। টিকার কার্যকারিতা বিষয়ে আগে থেকেই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সন্দেহ প্রকাশ করে আসছিলেন। তাদের মতে, ভ্যাকসিন তৈরিতে যতটা সময় দেওয়া প্রয়োজন এই ভ্য্যকসিন তৈরিতে সে সময় দেওয়া হয়নি। বিশ^বাসী অতিদ্রুত একটি প্রতিষেধক প্রত্যাশা করেছে। যতদ্রুততম সময়ে সে ভ্যাকসিন মানুষের দেহে পুশ করা যায় সেটিই ছিল লক্ষ্য। ফলে ভ্যাকসিনের কর্মক্ষমতা আশানুরূপ না হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান বেশ কিছুদিন থেকেই ভ্যাকসিনের বিষয়ে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করে আসছেন। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে তিনি তার অবস্থানে একটু ছাড় দিয়েছেন। তিনিও টিকার বিষয়ে অতীতের চিন্তা ধারা থেকে বের হয়ে এসে এটি মানবজীবনের জন্য শুভ ইঙ্গিত বলে স্বাগত জানিয়েছেন।
টিকা কী, কীভাবে তৈরি হয়? :করোনাভাইরাস খুবই ছোঁয়াচে, খুব সহজে ছড়াতে পারে। তাই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই এখনো এতে সংক্রমিত হবার ঝুঁকির মধ্যে আছে। এত বিপুল সংখ্যক মানুষকে কোভিড-১৯ থেকে রক্ষা করার একটা উপায় হলো টিকা আবিষ্কার। টিকা বা ভ্যাকসিন হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা মানুষের দেহের ভেতরকার রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শিখিয়ে দেয়; কীভাবে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। বিবিসি সংবাদদাতা লরা ফস্টারের মতে, করোনা টিকা আবিষ্কার মহামারি করোনাভাইরাসটি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, মহামারি করোনা প্রতিরোধে এটি কতটা কার্যকর হবে? হরিয়ানার স্বাস্থ্যমন্ত্রী অনিল ভিজ সেই সন্দেহকে অনেকটাই সামনে নিয়ে এলেন।