ড. কাজী এরতেজা হাসান
আমাদের মহান স্বাধীনতার সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দাতা দেশ ভুটান। এ কারণে ভুটানের জনগণ এবং ভুটান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে ঐতিহাসিক বন্ধুত্ব। বাংলাদেশের মানুষ সবসময় কৃতজ্ঞচিত্তে তাদের অবদানকে স্বীকার করে। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের যে বন্ধুত্ব তা ক্রমবর্ধমানভাবে বাড়ছে। সম্পর্ককে গভীর করতে এবং তা টেকসই করতে দুটি দেশই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভুটান পাহাড় আর সবুজ প্রকৃতি পরিবেষ্টিত একটি রাষ্ট্র। প্রকৃতির ভূ-স্বর্গও বলা যায় দেশটিকে। এখানকার মানুষের মধ্যে রয়েছে উদার অতিথিপরায়নতা। এ কারণে দেখা যায়, সারা বছরজুড়ে বাংলাদেশের মানুষ একটু ফুসরত পেলেই ছুটে যায় ভুটানে। ভুটানের যে ইতিহাস-ঐতিহ্য তা হাজার বছরের পুরানো। গত রোববার এই দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত সবিধা সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। দেশটি আমাদের দেশের ১০০টি পণ্যে প্রবেশে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশও ভুটানের ৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। এই চুক্তিকে ঐতিহাসিক চুক্তি হিসেবে অভিষিক্ত করা যায়।
বিশ্বনেতা-রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ রাষ্ট্র পরিচালনার ফলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান রয়েছে। দেশের নানা ক্ষেত্রে উন্নতি ও সমৃদ্ধির স্বাক্ষর যা বিশে^ নজির সৃষ্টি করেছে। ভুটান সরকার, বাংলাদেশের ১০০ পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছে, যা আমাদের অর্থনৈতিকে একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করবে। গতকাল দেশের প্রায় সব দৈনিক পত্রিকাগুলো এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন ছেপেছে। যা থেকে জানা যায়, ‘ভুটানের বাজারে ১০০টি পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা পেল বাংলাদেশ। ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল দেশে উন্নত হওয়ার পরও বাংলাদেশ এ সুবিধা পাবে। অন্যদিকে ভুটান বাংলাদেশের বাজারে ৩৪টি পণ্যের শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পাচ্ছে। গত রোববার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে এ সংক্রান্ত দ্বিপাক্ষিক অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি বা প্রিফারেন্সিয়াল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) স্বাক্ষর হয়েছে। নিজ নিজ দেশের পক্ষে চুক্তি সই করেন বাংলাদেশের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও ভুটানের অর্থ-বাণিজ্যমন্ত্রী লোকনাথ শর্মা। চুক্তি সই অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভুটান থেকে দেশটির প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং সংযুক্ত ছিলেন। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের ১০০ পণ্যের মধ্যে রয়েছেÑ তৈরি পোশাক শিল্প, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী যেমন- জুস, কনডেন্সড মিল্ক, বিস্কিট, মিনারেল ওয়াটার, পাউরুটি। কৃষিজাত পণ্যের ভেতরে অন্যতম হচ্ছে আলু। প্রসাধনী সামগ্রী, টয়লেট্রিজ পণ্য, সাবান ও শ্যাম্পু। এছাড়া শুঁটকি মাছ, সিমেন্ট, চা, ফ্লাইউড, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং পণ্যসহ অন্যান্য ব্যবহারিক পণ্য। এছাড়া পুরুষদের জ্যাকেট, ব্লেজার, ট্রাউজার, আন্ডারওয়্যার, বাচ্চাদের পোশাক, চকলেট, বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্য ও গুর্ডস, চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য, গার্মেন্টস পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, অ্যালোমিনিয়াম ডোর, কাঠের তৈরি পণ্য, ইলেকট্রনিকস পণ্য, ফুটওয়্যার, ক্যাবলস, ঘড়ি, বেল্ট, মেটাল ও প্লাস্টিক ফার্নিচার ইত্যাদি। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভুটানের যে পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে, সেগুলো হলো- বোল্ডার, জিপসাম, ডোলোমাইট, ফল ও জুস, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য যেমন জ্যাম ও জেলি, মসলা, ফার্নিচারসহ অন্যান্য পণ্য শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছে।
পরিশেষে বলা প্রয়োজন, পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদানের মধ্যদিয়েই বাংলাদেশ ও ভুটনা, উভয় দেশ অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে। পারস্পরিক অর্থনৈতিক সুবিধা দেওয়ার মধ্যদিয়ে উভয়ের লাভবানের যে দুয়ার উন্মোচিত হয়েছে, তা অনেক দেশ বুঝতে চায় না। কোনো কোনো দেশ শুধু এককভাবে শুল্কমুক্ত সুবিধা চায়, কিন্তু নিজে সুবিধা দিতে আগ্রহী নয়। এ ধরনের মনোভাবাপন্ন দেশের সঙ্গে অবশ্য অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে বন্ধন তৈরি করা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা আশা করবো, বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলো বাংলাদেশের পণ্যের ওপর বিশেষ শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়াতে সহযোগিতা করে যাবে। বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সদস্য। ডব্লিউটিও বিধি বিধান মেনে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক প্রিফারেন্টাল ট্রেড এগ্রিমেন্ট (পিটিএ) আলোচনা বা নেগোসিয়েশন অব্যাহত রেখেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২২-২৩ আগস্ট ২০১৯ তারিখ ভুটানের সঙ্গে থিম্পুতে পিটিএ নেগোসিয়েশন কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়। গত ১৬ জুন ২০২০ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সভায় খসড়া পিটিএ চুক্তি ও এর সঙ্গে সংযুক্ত রুলস অব ডিটারমিনেশন অব ওরজিন (আরও) নিজ নিজ দেশের অনুমোদনের পর স্বাক্ষরের জন্য চূড়ান্ত করা হয়। বিধি মোতাবেক চুক্তিটি স্বাক্ষরের পর ডব্লিটিওতে নোটিফাই করা হবে।
উল্লেখ্য, ২০০৮-০৯ অর্থ বছরে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে মোট বাণিজ্য ছিল ১২ দশমিক ৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশ শূন্য দশমিক ৬১ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য রফতানি করে ও একই সময়ে আমদানি করে ১২ দশমিক ১৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দু’দেশের বাণিজ্য ৫৭ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়। এ সময় বাংলাদেশ রফতানি করে ৭ দশমিক ৫৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য, একই সময়ে ভুটান থেকে আমদানি হয় ৪৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার মূল্যের পণ্য। এভাবেই ভুটান আর বাংলাদেশ বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে যে নব দিগন্তের সূচনা করলো আগামীতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে বলেই অর্থনীতিবিদদের ধারণা। আর এসবই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদৃষ্টির বাস্তবায়ন।