প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:০৭ এএম আপডেট: ০৮.১২.২০২০ ২:১৯ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
আজ বিজয়ের মাসের অষ্টম দিন। এদিনে মুক্তিবাহিনী দোর্দ- প্রতাপে সম্পূর্ণভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে পাকবাহিনী। প্রবল আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পড়ে তারা। পাক সৈন্যদের ঢাকার দিকে পালাবার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা যৌথবাহিনীর তিনটি ব্রিগেড নিয়ে দ্রুত অগ্রসর হয় ঢাকার দিকে। একটি ব্রিগেড যায় হালুয়াঘাট থেকে ময়মনসিংহের দিকে। আকাশবাণী বেতার থেকে নানা ভাষায় জেনারেল মানেকশ বারবার আহ্বান করেন পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার। আশ্বাস দেন, আত্মসমর্পণ করলে পাকবাহিনীর প্রতি সম্মানজনক ব্যবহার করা হবে জেনেভা কনভেনশনের রীতি অনুযায়ী। এ দিন ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা ক্লেয়ার হোলিংওয়ার্থ জানান, কামানের গোলাবর্ষণে সারা পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে ঢাকা। শুধু কাজ করছে কয়েকটি টেলিফোন। টেলিগ্রাফও মাঝে মধ্যে সচল হচ্ছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বাগানে খোড়া হচ্ছে ট্রেঞ্চ। কিন্তু এতকিছুর পরও পাক সামরিক শাসকরা আত্মসমর্পণের দিকে না গিয়ে সেনাসদস্যদের নির্দেশ দেয় যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। এদিকে, পরাজয় নিশ্চিত জেনে পূর্ব পাকিস্থানের গভর্নর ডা. মালেক ইসলামাবাদে বার্তা পাঠান মুক্তিবাহিনীর দাবি মেনে নিয়ে একটি সমঝোতায় উপনীত হবার। মুক্ত হতে থাকে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। এই দিন ভোরে মুক্তিসেনারা কুমিল্লা শহরের চকবাজার টমছম ব্রিজ ও গোমতী পাড়ের ভাটপাড়া প্রবেশ করে ঝড়ের বেগে। বিকেলে কুমিল্লা টাউন হল মাঠে বীর মুক্তিযোদ্ধা মিত্রবাহিনী জনতার উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন পূর্বাঞ্চলের প্রশাসনিক কাউন্সিলর চেয়ারম্যান জহুর আহমেদ চৌধুরী এবং অ্যাডভোকেট আহমদ আলী। মুক্তিবাহিনী পাকবাহিনীর প্রবল প্রতিরোধের মুখোমুখি হয় চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে প্রায় ৩৬ ঘণ্টা ধরে চলে যুদ্ধ। অতঃপর, পরাস্ত হয়ে পালাতে শুরু করে পাকবাহিনীর ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশন। মুক্ত হয় চাঁদপুর। সকাল ১০টার দিকে মহকুমা শহরে লে. কর্নেল সুট্টির নেতৃত্বে ট্যাংক বহর নিয়ে প্রবেশ করে যৌথবাহিনী। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর একটি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্ত করে এগোয় ঢাকার দিকে। অপর একটি বাহিনী এগিয়ে যায় আশুগঞ্জের সেতুর দিকে। বিনা বাধায় সরাইলে পৌঁছায় ‘এস’ ফোর্স। সন্ধ্যার মধ্যে একাদশ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আশুগঞ্জের পূর্বপাশে আজমপুর এবং দুর্গাপুরে সমাবেশ করে। সরাইল এবং শাহবাজপুরের মধ্যে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং সেক্টরভুক্ত এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পেছন দিক থেকে অগ্রসর হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভারতীয় প্রতিনিধি সমর সেন বলেন, পাকিস্তানকে অবশ্যই বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিতে হবে। উপমহাদেশে শান্তি পুনঃস্থাপনের জন্য মুক্তি দিতে হবে শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য না হলে জাতিসংঘের কোন প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা যাবে না। ওইদিনই ভোরে কমান্ডার আফতাব উদ্দিন খান ১৭০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা গান স্যালুটের মাধ্যমে উত্তোলন করেন কুষ্টিয়ার মিরপুর থানায়। এরপর পাহাড়পুর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আত্মসমর্পণ করে ৬৫ জন পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর। শত্রু মুক্ত করে বিজয় পতাকা উড়ানো হয় কুষ্টিয়ার দৌলতপুর থানা চত্বরে। সবচেয়ে বড় যুদ্ধ সংঘঠিত হয় উপজেলার ধর্মদহ ব্যাংগাড়ী মাঠে। এ যুদ্ধে শহীদ হন ৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ৩ জন ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সদস্য। আল্লারদর্গায় পাক সেনারা গুলিতে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা রফিক। পাক হানাদার মুক্ত হয় চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলা। পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে হতাশ হয় জেনারেল নিয়াজী। রাওয়ালপিন্ডির সামরিক কর্তারা তাকে জানায় চীনা তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইয়াহিয়া খান দ্বিধান্বিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নুরুল আমিন ও পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে যথাক্রমে প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করে। যুদ্ধ পরিস্থিতি অবগতি করে ভারতের সরকারি মুখপাত্র ঘোষণা করে, পাকিস্তান যদি পূর্ব বাংলায় তাদের পরাজয় স্বীকার করে নেয়, তবেই অন্যান্য সকল অঞ্চলেই ভারত যুদ্ধ বন্ধ করবে; বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের কোন ভূখ-ই দখল করার অভিপ্রায় ভারতের নেই। এই ঘোষণা বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা বাদে ওয়াশিংটন থেকে হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের জন্য ‘সামরিক সরবরাহ’ নিশ্চিত করার পক্ষে দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেন।
সূত্র :স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মূলধারা’৭১, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর