মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে দুই মামলায় সোমবার (৭ ডিসেম্বর) পুরান ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে হাজির করা হয়। তার বিরুদ্ধে করা কর ফাঁকির মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুনানি পিছিয়েছে। আর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের দেওয়া জাকাতের অর্থ আত্মসাতের মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ২৮ ডিসেম্বর ধার্য করেছেন আদালত।
সোমবার (৭ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে বকশিবাজারের আদালতে হাজির করা হয়। বেলা পৌনে ১১টার আবার কারাগারের উদ্দেশে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সাঈদীকে বকশীবাজারের আদালতে হাজির করার কারণে ওই এলাকায় ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। আদালতের প্রাঙ্গণ ঘিরে পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে। এদিন তালিকাভুক্ত আইনজীবী ছাড়া আর কাউকেই আদালতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
এদিন আদালতে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলেন জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। আইনজীবীদের তিনি বলেন, আদালত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলে খালাস পাবেন তিনি।
সাঈদী আরো বলেছেন, মামলার সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। আদালত যদি ন্যায় বিচার নিশ্চিত করে তাহলে তিনি খালাস পাবেন। তিনি দেশবাসীকে সালাম জানিয়েছেন এবং তার জন্য দোয়া করতে বলেছেন। তিনি বলেছেন, আল্লাহ যেন আমাকে ঈমানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার তওফিক দান করেন। কেয়ামতে ময়দানে আল্লাহ যেন আমাকে পুরষ্কৃত করেন। তিনি সারাবিশ্বের আলেম, ওলামা, বাংলাদেশের জনগণ, আপামর জনতার কাছে তার সালাম পৌঁছে দিবেন।
সাঈদীর আইনজীবী মতিউর রহমান আকন সাংবাদিকদের জানান, সোমবার দুই মামলায় তাকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল। ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়েছে। তিনি এখন কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে কঠিন এবং মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ অবস্থায় শুধুমাত্র হয়রানি করার উদ্দেশ্যে দুটি মামলায় তাকে আজ আদালতে হাজির করা হয়।
তিনি জানান, ৮২ বছর তার বয়স। শারীরিকভাবে তিনি খুবই অসুস্থ। তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। হাঁটতে পারেন না। অন্যের সহযোগিতা লাগে। এ অবস্থায় তাকে যে কষ্টটা দেয়া হলো তা অত্যন্ত কষ্টদায়ক এবং বেদনাদায়ক। আমরা তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলার বিরুদ্ধে আদালতে বক্তব্য উপস্থাপন করেছি।
রাষ্ট্রপক্ষের সরকারি কৌঁসুলি রফিক উদ্দিন বলেন, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কারাগার থেকে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আদালতে হাজির করা হয়। তার পক্ষে শুনানি করেন তার আইনজীবী। মামলা দুটির শুনানি শেষে তাকে আবার আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ শুনানি পিছিয়ে আগামী ৬ জানুয়ারি মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ঠিক করেছেন আদালত।
সোমবার বকশীবাজারের বিশেষ জজ আদালত-৩ এ সাঈদীর বিরুদ্ধে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) করা আয়কর ফাঁকির আরেক মামলায় বাদীপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। আগামী ৬ই জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেছেন এই আদালতের বিচারক নজরুল ইসলাম।
মামলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ৫৬ লাখ ৪৬ হাজার ৮১২ টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়। মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী ২০১১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে কর ফাঁকির মামলায় অভিযোগ গঠন করেন আদালত। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এই মামলায় কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ১৯ আগস্ট কর সার্কেল ৫১ কর অঞ্চলের তৎকালীন উপ–কর কমিশনার মাসুমা খাতুন বাদী হয়ে মামলা করেন।
জাকাতের অর্থ আত্মসাতের মামলায় দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি পিছিয়েছে। ২৮ ডিসেম্বর মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করেছেন আদালত। সোমবারঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১–এর বিচারক সৈয়দা হোসনে আরা এ আদেশ দেন। ওই আদালতের বেঞ্চ সহকারী রবিউল ইসলাম জানান, আসামিপক্ষ থেকে এই মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য আদালতের কাছে সময় চেয়ে আবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিপক্ষের আবেদনের বিরোধিতা করে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়। শুনানি শেষে আদালত অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ঠিক করেন।
মামলার কাগজপত্রের তথ্য অনুযায়ী, জাকাতের ১ কোটি ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অর্থ ও হিসাব বিভাগের তৎকালীন পরিচালক আইয়ুব আলী চৌধুরী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ চারজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করে ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল দুদকের সহকারী পরিচালক ওয়াজেদ আলী গাজী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছাড়া মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত অপর ছয়জন আসামি হলেন সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মো. লুৎফুল হক, আবুল কালাম আজাদ, মিয়া মোহাম্মদ ইউনুস, তোফাজ্জল হোসেন ও আবদুল হক। তাঁদের মধ্যে সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ মারা গেছেন। পলাতক আবুল কালাম আজাদ। অন্যরা জামিনে। আজ জামিনে থাকা চার আসামি আদালতে হাজির ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেন আপিল বিভাগ। ২০১০ সালের ২৯ জুন সাঈদী গ্রেপ্তার হন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে। পরে ২ আগস্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।