প্রকাশ: সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:১১ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
কক্সবাজার জেলা সদরে গণহত্যা সূচনা হয় ১৯৭১ সালে মে মাসে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটের ফুলতলীর যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের নৃশংসভাবে হত্যা করার পর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ৫ মে স্থলপথে ১১৫টি গাড়ি নিয়ে এবং জলপথে একযোগে কক্সবাজার শহরে প্রবেশ করে। বিশেষ অবস্থানগত কারণে এ এলাকার প্রতি পাকিস্তানি বাহিনীর দৃষ্টি ছিল খুবই দুরভিসন্ধিমূলক। কারণ পাকিস্তানি বাহিনী শহরে প্রবেশের অনতিপূর্বে বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ শহরের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিয়ে কৌশলে পাহাড়ে ও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র বার্মায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ সময়ে এই মহকুমার সর্বত্র পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে শান্তি কমিটির নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী গড়ে ওঠে। এদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মহকুমার বিভিন্ন থানায় মুক্তিকামীদের হত্যাকা-ের কাজ শুরু করে নরপশুরা। তারা কক্সবাজার মহকুমা হেড কোয়ার্টারে অবস্থান নেয় এবং শহরের সি-বিচ রেস্ট হাউসে তারা প্রধান ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর পাকিস্তানি বাহিনী সারা জেলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
কক্সবাজার সদর উপজেলার কক্সবাজার সি-বিচ রেস্ট হাউজে কমপক্ষে ৫০টি গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এ জেলার স্বাধীনতাকামী মুক্তিসংগ্রামী নারী-পুরুষদের হত্যাকেন্দ্র বা টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহৃত হত সি-বিচ রেস্ট হাউজ, যেটি বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ১৬ ইসিবি কার্যালয়। তার পেছনেই জেলা শিল্পকলা একাডেমি পুরানো কার্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় কক্সবাজার ছিল চট্টগ্রামের একটি মহকুমা। মহকুমার বিভিন্ন এলাকা থেকে শান্তিপ্রিয় নারী ও পুরুষকে ধরে এনে সি বিচ রেস্ট হাউজের দুটো কক্ষে বেঁধে রাখা হতো। তাদের ওপর চলতো অমানুষিক অত্যাচার। নারীদের নানা রকমভাবে নির্যাতন করা হতো। বন্দিদেরকে দিয়েই খোঁড়ানো হতো নিজেদের কবর। এরপর খোঁড়া গর্তের সামনে দাঁড় করে গুলি করে হত্যা করা হতো। প্রতি রাতে এখানে গণহত্যা ছিল একটি রুটিনমাফিক কাজ।
প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কক্সবাজার সদর উপজেলার এই স্থানে নয় মাসে অন্তত ৫০টি গণহত্যার ঘটনা ঘটিয়েছে। কক্সবাজার শহর, পার্শ্ববর্তী খুরুস্কুলসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী মানুষ, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্র-যুবক ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষকে এনে এখানে হত্যা করা হতো।
কক্সবাজার সি বিচ রেস্ট হাউজের সামনের অংশটি জেলার বৃহত্তম বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় রেস্ট হাউজের সামনে বিস্তৃত ঝাউবাগান এবং আশপাশের বিস্তীর্ণ বালিয়াড়ি, ঝোপঝাড়কেই গণহত্যার জন্য বেছে নিয়েছিল পাক বাহিনী। বর্তমানে এখানে মাদরাসা, স্কুলসহ বিভিন্ন ইমারত নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে মহকুমার বিভিন্ন এলাকা এবং এর বাইরে থেকে বাঙালি নারী-পুরুষকে ধরে এনে প্রতিরাতে ব্রাশফায়ার করে মারা হতো। এরপর বালুচরে ফেলে দেওয়া হতো লাশ। এই সি বিচ রেস্ট হাউজের পেছনে ছিল একটি পাতকুয়া, যেখানে মুক্তিসংগ্রামী অসংখ্য শহিদের রক্তের দাগ লেগে আছে। মুক্তিযুদ্ধের পর এ কুয়াতে পাওয়া গেছে অসংখ্য মানুষের মাথার খুলি, হাড়-গোড় ও কংকাল। যেখানে পাওয়া যায় অনেক নারীর শাড়ি, ব্লাউজ, পুরুষের শার্ট, প্যান্ট, মেয়েদের চুল।
স্থানীয়রা জানায়, পাতকুয়ার পানি মানুষের রক্তের ধারায় লাল হতে হতে নিকষ কালো বর্ণ ধারণ করেছিল। লোকজনকে হত্যা করার পর রেস্ট হাউসের পশ্চিমে বালিচাপা দিয়ে রাখা হতো সব মৃতদেহ। রাত পোহালেই দেখা যেত ওই সব মৃতদেহ শেয়াল-কুকুর টানাটানি করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের ১৬ ইসিবি অফিস স্থাপনের আগেও এখানে মানুষের মাথার খুলি ও হাড়ের সন্ধান মিলতো। মুক্তিযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া স্থানীয় অনেক তরুণ জানিয়েছেন, গত শতকের ৯০-এর দশকেও তারা সি বিচ রেস্ট হাউজের মাঠে খেলতে গিয়ে বা ঝাউবনে ঘুরতে গিয়ে প্রায়ই মানুষের মাথার খুলি, হাড়-গোড়, কঙ্কাল, মাটি চাপা রক্তমাখা শার্ট-প্যান্ট খুঁজে পেতেন। জানা গেছে, এ রেস্ট হাউজ ও আশপাশের এলাকায় আনুমানিক ২০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়।
এছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ বাহারছাড়া রাডার স্টেশনের পাদদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালায়। স্থানীয় প্রবীণদের অনেকের বয়ানে তার সাক্ষ্য মেলে। কক্সবাজার জেলায় ৫ মে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগমনের পরে ৬ মে থেকে মুক্তিকামী লোকজনকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ওই স্থানে হত্যা করা হতো। মিত্র বাহিনী কর্তৃক ৬ ডিসেম্বর কক্সবাজার বিমান বন্দরে বোমা হামলার পূর্ব পর্যন্ত হানাদার বাহিনী এখানে নির্যাতন ও গণহত্যা অব্যাহত রাখে। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, এখানে ২০টিরও বেশি গণহত্যা সংঘটিত হয়। তবে সুনির্দিষ্টভাবে কাদেরকে ওই স্থানে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো তথ্য জেলা প্রশাসন এবং জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছে নেই।
কক্সবাজারে ১৯৭১ সালে সংগঠিত গণহত্যা নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক জগন্নাথ বড়ুয়া। তার গবেষণায় দেখা গেছে মে থেকে শুরু হয়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই প্রায় ৭ মাস ১০ দিন সময়ে কক্সবাজারে ১৯৫টি ছোট বড় গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বধ্যভূমি, নির্যাতন কেন্দ্র আর গণকবরসহ এই সংখ্যা মোট ২৬৭টি। অথচ দীর্ঘদিন পর্যন্ত মনে করা হতো কক্সবাজারে সংগঠিত গণহত্যার সংখ্যা মাত্র ১৭টি। মূলত গণহত্যার সঠিক সংজ্ঞায়ন না করতে পারায় বহু গণহত্যার ঘটনাই আমাদের পূর্বের গবেষণাগুলোতে উঠে আসেনি। আমরা শুধু কিলিং স্পট বা বধ্যভূমির সংখ্যাকেই হিসেব করেছি। পাকবাহিনী কর্তৃক বিচ্ছিন্ন হত্যাকা-, নির্যাতনকেন্দ্র বা টর্চার সেলগুলোতে হত্যাকা- গ্রাম অভিযানগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চালানো হত্যকা- আমাদের পূর্বতন হিসেবে উঠে আসেনি। এখন সংজ্ঞায়ন স্পষ্ট হলেও স্বাধীনতার পর অতিবাহিত হয়েছে পঞ্চাশটি বছর। ফলে এখন অনেক স্থানই হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন অনেক তথ্য। কেউ কেউ স্মৃতিভ্রষ্ট হয়েছেন। গণহত্যার সাক্ষীদের অনেকে বেঁচেও নেই আর। ফলে সি বিচ রেস্ট হাউজ গণহত্যায় শহীদদের সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য হলেও আমাদের এইসব গণহত্যার স্থান ও তথ্যগুলো সংরক্ষণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি।