প্রকাশ: সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ৭:০৭ পিএম | অনলাইন সংস্করণ
দিনাজপুর বাংলাদেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা এখানে গণহত্যার ইতিহাসে নির্মম কিছু গণহত্যা পরিচালনা করে। এখনো দিনাজপুরের গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এই গণহত্যা ও নির্যাতনের স্মৃতিচিহ্ন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বর্ণনায় বারবার কেবল ঘুরে ঘুরে এসেছে বিজয়ের ইতিহাস। বিজয়গাঁথার চাপে হারিয়ে গেছে নিপীড়ন আর গণহত্যার ইতিহাস। আজ সময় এসেছে নতুন প্রজন্মের কাছে গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরার। কারণ এই দেশটাকে স্বাধীন করতে যেই মানুষগুলো প্রাণ দিয়ে গেলো সেই মানুষগুলোর আত্মত্যাগের ইতিহাস না জানলে কখনোই একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না।
আজকে আমরা আলোচনা করবো দিনাজপুর সদরের অদূরের একটি অনালোচিত পাকিস্তানি ক্যাম্প নিয়ে আর সেই ক্যাম্পে সংগঠিত কিছু গণহত্যা নিয়ে। দিনাজপুর শহর থেকে দক্ষিণ দিকে পুলহাট, সিকদারহাট হয়ে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে রামসাগরের অবস্থান। এখানেই গড়ে উঠেছিল এলাকার সবচেয়ে বড় পাকিস্তানিদের ডিফেন্স ক্যাম্প। প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সেনা এখানে নিয়মিত অবস্থান করতো। এখানে কর্নেল আব্দুর রশিদ ও মেজর জাফর আলির নেতৃত্বে পাকিস্তানিদের এক ব্যাটালিয়ানে প্রায় ৮৫২ জন সৈন্য অবস্থান করেছিল। তাদের মূল ক্যাম্প ছিল রামসাগরের ডাকবাংলোয়। ডাকবাংলোর চারদিকে ছিল ছাদযুক্ত বড় বড় বাংকার। দিনাজপুরের দক্ষিণ কোতওয়ালী এলাকার বিভিন্ন গ্রামে ও পুকুরপাড়ে ছড়িয়ে থাকা স্থায়ী ও অস্থায়ী প্রায় ২০টি সাব ক্যাম্প ও প্রতিরোধ ঘাঁটি পরিচালিত হতো এই রামসাগর ক্যাম্প থেকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় জানা যায়, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন গ্রাম থেকে স্থানীয় গ্রামবাসীদের ধরে এনে রামসাগরের পশ্চিমপাড়ে নির্যাতন করতো। নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করতো। এখানে বিভিন্ন সময়ে প্রায় ২৫০ জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে বেশ কয়েকটি গণহত্যার ঘটনা ঘটে এই স্থানে। এসময় বিভিন্ন গ্রাম টহল দিয়ে পাকিস্তানিরা রাজাকারদের সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের ধরে বেঁধে এনে নির্যাতন করা হতো। এছাড়া ভারত পলায়নরত শরণার্থীদের, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে ধরে এনে নির্যাতনের পর গুলি করে মেরে ফেলত হানাদার বাহিনী। মহতুল্লাপুর গ্রামের কামারপাড়ার একই পরিবারের ৪ জনকে রামসাগরে ধরে এনে নির্যাতনের পর গুলি করে মারা হয় বলে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানে জানা যায়। এই চারজনের মৃতদেহ রামসাগরের উত্তর-পশ্চিম কোণে বাঁশঝাড়ের নিচে মাটিচাপা দেওয়া হয়। এছাড়া গৌরীপুর ও ভজনাপাড়া থেকে অনেককেই ধরে এনে গুলি করে মেরে ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে মাটিচাপা দেওয়া হয়। রাঘবপুর থেকে একই পরিবারের ৩ জনকে এখানে এনে গুলি করে হত্যা করা হয়।
রামসাগরের পশ্চিম প্রাচীর সংলগ্ন তাজপুর দিঘীপাড়ার সংগঠিত একটি গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী আব্দুল মজিদ বলেন, রামসাগরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একইদিনে প্রায় ১৫ জনকে মেরে মাটিচাপা দেওয়া হয়। আরও একদিন পশ্চিমের বাঁশঝাড়ের কাছে প্রায় ৮ জনকে এনে গুলি করে মাটিচাপা দেয় হানাদার বাহিনী। মহররমপুরের ১ জনকে ধরে এনে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারে পাকিস্তানিরা। কমলপুরের ৩ জনকে এনে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি সেনারা। এছাড়া ১৭ এপ্রিল রামসাগরের উত্তর সংলগ্ন পাইকপাড়ায় রুস্তম আলি মাস্টারকে হত্যা করে ব্রিজের নিচে ফেলে রাখে পাকিস্তানিরা।
রামসাগরের পাশে দিনাজপুর শহরের পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে ছিল অবাঙালি বিহারিদের বসবাস। এই অবাঙালিদের একটি অংশ আশপাশে প্রায় বিশটি গণহত্যা পরিচালনা করে। ২০ এপ্রিল নিউটাউনের নিকটবর্তী ফরিদপুরের বিভিন্ন বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয় পাকিস্তানি এবং দুর্বৃত্ত বিহারিরা। পলায়নপর অনেক মানুষকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে তারা। মুরগির ঘরে লুকিয়েও রক্ষা পায়নি স্থানীয় যুবক কানু।
এদিকে এপ্রিলের ২০ তারিখ দুপুরে পাকিস্তানি সেনার ১২ জনের একটি দল রামসাগর ক্যাম্প থেকে টহল দিতে এসে ঘুঘুডাঙ্গায় একদল বাঙালিকে হত্যা করে। ঘুঘুডাঙ্গা গ্রামটি ৬ নং আউলিয়াপুর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত। রামসাগর থেকে সোজা পশ্চিমে প্রায় ৩ কিলোমিটার এবং খাড়িপাড়া থেকে ২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমের সুন্দরা ক্যাম্পগামী রাস্তার ওপর এই গ্রামটির অবস্থান। এদিন দুপুরে পাকিস্তানিরা ঘুঘুডাঙ্গার মোল্লাপাড়া, পুরাতনপাড়া , গৌরীপুর ও ভোজনাপাড়া এলাকায় প্রবেশ করে কয়েকজনকে ধরে রামসাগর নিয়ে যায়। সেখানে নির্যাতনের পর গুলি করে মারে। স্থানীয় শুকু মোহাম্মদকে পাড়ার রাস্তায় ধরে বেয়নেট দিয়ে তার চোখ তুলে নেয় পাষ-রা। তারপর লাঠি দিয়ে প্রহার করে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে গুলি করে চলে যায়। পরে গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক লোক লাশটিকে মাটিচাপা দেয়। আরেক স্থানীয় শামসুদ্দিনকে ধরে পাথরঘাটায় নিয়ে গিয়ে গাছের সাথে বেঁধে ঝুলিয়ে নির্মমভাবে প্রহার করতে করতেই মেরে ফেলে হানাদার বাহিনী। এ লাশটি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া আবুল হোসেন ও এসু মোহাম্মদকে রামসাগরে ধরে নিয়ে যায় এবং নির্যাতনের পর গুলি করে মারে পাকিস্তানিরা।
দিনাজপুরের গণহত্যা গবেষক মোজাম্মেল বিশ্বাস আমাদের জানিয়েছেন পুরো ৭১ সালে দিনাজপুরে দেড় হাজারের উপর গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রতিটি গণহত্যার সর্বনিম্ন একজন থেকে শুরু করে শতাধিক মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। তার ধারণা অনেক গণহত্যার স্থান ও বধ্যভূমি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। মোজাম্মেল বিশ্বাস দিনাজপুর জেলার গণহত্যার জরিপ পরিচালনা করেন। তার পরিচালিত জরিপটি প্রকাশিত হবার পর এই অঞ্চলের গণহত্যার অনেক নতুন নতুন ইতিহাস মানুষের কাছে উঠে এসেছে।