৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন, কারণ একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে সে দিনটি আমরা প্রথম অন্য দেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হই আর স্বীকৃতি প্রদানকারী প্রথম দেশটি ছিল ভারত এবং একই দিন স্বীকৃতি প্রদান করেছিল ভুটান। সেদিনের স্বীকৃতি যে কত অপরিহার্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ ছিল, তা আজ চিন্তায় আনা কঠিন। যারা সে সময় জীবিত ছিলেন তারা জানেন সেদিনের স্বীকৃতি আমাদের জন্য কত প্রয়োজনীয় ছিল। উল্লেখ্য, সেদিনও আমরা পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে আমাদের মাটি থেকে উৎখাত করে দেশকে পুরোপুরি দখলমুক্ত করতে পারিনি। বিশেষ করে ভারতের স্বীকৃতির খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যম বহু গুণে বেড়ে গিয়েছিল, তারা আরও অধিক সক্ষমতার সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের দর্প চূর্ণ করতে পেরেছিলেন।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নাম দিয়ে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর দিন থেকেই ভারতের জনগণ এবং রাজনীতিকরা সরকারের ওপর প্রবল চাপ দিতে থাকেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার। ভারতের কেন্দ্রীয় সংসদের উভয় কক্ষে, অর্থাৎ রাজ্যসভা এবং লোকসভায় বহুবার দাবি ওঠে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার, দাবি ওঠে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়ও। কিন্তু সে সময় ভারতের অতি বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জানতেন স্বীকৃতি দেওয়ার সময় সেটি ছিল না, অর্থাৎ তখন স্বীকৃতি দিলে হিতেবিপরীত হতো।
স্বীকৃতির প্রশ্নটি আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সে মতে, নতুন রাষ্ট্রকে তখনই স্বীকৃতি দেওয়া যায় যখন সে দেশের ভূমি তার নিয়ন্ত্রণে, সে দেশে একটি প্রতিষ্ঠিত এবং নিয়ন্ত্রক সরকার থাকে এবং এর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত। এ ছাড়া যেটা দেখার বিষয় তা হলো- নতুন রাষ্ট্র এবং সরকারের স্থায়িত্বের প্রশ্ন এবং অন্য দেশের সঙ্গে চুক্তি করাসহ অন্যান্য সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষমতা। স্বীকৃতির প্রশ্ন বিবেচনায় সাধারণত ১৯৩৩ সালের মন্টিভিডিও কনভেনশনের বিধান বিবেচনা করা হয়, যা হচ্ছে দেশটির (১) একটি জনসংখ্যা (২) নির্ধারণযোগ্য ভৌগোলিক সীমারেখা (৩) একটি স্বীকৃত সরকার এবং (৪) অন্য দেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক স্থাপনের সামর্থ্য।
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে স্বীকৃত রাষ্ট্র একটি আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদায় ভূষিত হয়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক এবং ব্যবসা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- স্বীকৃতি না পেলে কোনো রাষ্ট্র জাতিসংঘের সদস্য হতে পারে না, কোনো কনভেনশনের পক্ষ হতে পারে না এবং সে দেশের নাগরিকরা অন্য দেশে যেতে পারে না, যে কথাগুলো স্টিমসন ডকটরাইনে এবং নামিবিয়া সংক্রান্ত প্রশ্নে আন্তর্জাতিক আদালত বলেছে। একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই যে, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত হয়নি এমন দেশকে কেউ আক্রমণ করলে সে আন্তর্জাতিক আইনে কোনো প্রতিরক্ষা পাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে না। সোজা কথায়, বিভিন্ন দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পরেই নতুন রাষ্ট্রটি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদা এবং আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বের মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়। আন্তর্জাতিক আইনের একটি তথ্যমতে, একটি ভূখ- তখনই রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হয় যখন সে অন্য রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। অন্য কোনো দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার আগে নতুন রাষ্ট্রকে যেসব শর্ত পূরণ করতে হয়, ১৯৭১-এর ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ তা পূরণ করতে পারেনি এ জন্য যে, তখনো তার নিয়ন্ত্রণে একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানা ছিল না, যা ছিল পাকিস্তানি সেনা ও শাসকদের দখলে।
১৯৭১-এর ৬ ডিসেম্বর ভারত এবং ভুটান যখন বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয় তখন একটি মোটামুটি নির্ধারণযোগ্য ভূখ- বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে ছিল বিধায় আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন অনুযায়ী, বিশেষ করে মন্টিভিডিও কনভেনশন অনুযায়ী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু তৎপূর্বে নয়। অবশ্য আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী স্বীকৃতি ভূতাপেক্ষিকভাবে বিবেচিত হয়। ভারত-ভুটানের স্বীকৃতির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ প্রাণের স্পন্দন পেল, আন্তর্জাতিক সত্তায় পরিণত হলো। সে দিনটিও বাংলাদেশের গোটা অঞ্চল শত্রুমুক্ত হয়নি। তদুপরি তখনো চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে আক্রমণ করতে পারে এমন আশঙ্কা ছিল অত্যন্ত প্রবল। তবে ভারত-ভুটানের স্বীকৃতির কারণে তখন চীন বা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অভিযান চালালে বাংলাদেশ ভারত-ভুটানের সাহায্যে চাইতে পারত এবং আন্তর্জাতিক আইনে এটি চীন আমেরিকার অবৈধ আক্রমণ হিসেবে বিবেচিত হতো কেলগ-ব্রাইনড চুক্তি মোতাবেক। তাছাড়া আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের দাবি বহুলাংশে খর্ব হয়ে যায়। এই স্বীকৃতির আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি জেলে আটকিয়ে রাখা বা তথাকথিত রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে তাঁর বিচার করার আইনসংগত অধিকার থেকে পাকিস্তান বঞ্চিত হয়েছিল, কেননা বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানি নাগরিক রইলেন না, আন্তর্জাতিক অর্থে হয়ে গেলেন নতুন সৃষ্ট সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান। ৬ ডিসেম্বরের পর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিক মর্যাদা এবং প্রকৃতিরও পরিবর্তন হলো, এটি পরিণত হলো বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান নামক দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের যুদ্ধে। এই স্বীকৃতি যে চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে বাংলাদেশ আক্রমণ থেকে নিবৃত করেছিল তাও অনেকটা আস্থার সঙ্গেই বলা যায়। কেননা সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে অন্য দুটি দেশের স্বীকৃতি পাওয়ার পর চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ আক্রমণ করলে ভারত এবং ভারতের সঙ্গে চুক্তির কারণে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াতে পারত এবং দাঁড়িয়ে ছিলও বটে। ভারতের স্বীকৃতি অন্যান্য দেশের জন্য বাংলাদেশকে স্বীকৃতির দাঁড় উন্মোচন করে দেয়, যার ফলে শিগগিরই আরও বহু দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে, যাদের মধ্যে ছিল মিয়ানমার, মঙ্গোলিয়া, নেপাল এবং পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। আন্তর্জাতিক আইনে Implied বা অপ্রকাশিত স্বীকৃতির তত্ত্বও প্রচলিত রয়েছে। সে অর্থে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশকে অপ্রকাশিত বা Implied স্বীকৃতি দিয়েছিল ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে, তাঁকে ভিভিআইপি আতিথেয়তা প্রদান করে এবং তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। ভারত এবং ভুটানের স্বীকৃতির কারণেই ব্রিটেন এটি করতে পেরেছিল। স্বীকৃতির ফলে বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘের দ্বারও খুলে গিয়েছিল এবং চীন বিরোধিতা না করলে ১৯৭২ সালেই বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ পেত। সেই সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের জন্য প্রচুর বিদেশি সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, যা এই স্বীকৃতির ফলস্বরূপ পাওয়া গিয়েছিল।
ভারতের স্বীকৃতির আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এই যে, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণ ছিল ভারতীয় এবং বাংলাদেশ যৌথবাহিনীর কাছে, অর্থাৎ এখানে বাংলাদেশি বাহিনী, অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীকে রাখা আইনত সম্ভব হয়েছিল, ওই তারিখের আগেই ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বলে। তাছাড়া ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই সিমলায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও চুক্তিতে বাংলাদেশের কিছু বিষয় সংশ্লিষ্ট ছিল এবং তা সম্ভব হয়েছিল তার আগেই ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বলে। সিমলা চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত কিছু কথা বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিল।
১৯৭১-এ ৮ থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি এবং পরিদর্শক পাঠানোর জন্য সর্বমোট চারটি প্রস্তাব উঠালে সৌভিয়েত ইউনিয়ন সেসব প্রস্তাব ভেটো দিয়ে নস্যাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তি নিশ্চিত করেছিল। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়ন তখনো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও ভারতের স্বীকৃতির কথা পরোক্ষভাবে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের মুক্তির জন্য সৌভিয়েত ভেটো ছিল একান্ত অপরিহার্য।
এই স্বীকৃতির কারণেই বঙ্গবন্ধু ফেরার পরপরই ভারতের সঙ্গে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি করা সম্ভব হয়েছিল।
আজ অনেকেই কথায় কথায় ভারতবিরোধী প্রচারণা চালাচ্ছে। অবশ্য তাদের অধিকাংশই সেসব মানুষের বংশধর, যারা পাকিস্তান ভেঙে স্বাধীন বাংলাদেশ চাননি, কিন্তু ভারত আমাদের মুক্তির জন্য কী করেছে এবং সেদিন ভারতের স্বীকৃতি না পেলে কী হতো, এ কথা আজ তারা ভেবে দেখেন না। সুত্র-বাংলাদেশ প্রতিদিন
লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।