গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারে এসে আশ্রয় নেয় লাখো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তাদের থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর অংশ হিসেবে শুক্রবার এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে। নৌবাহিনীর মোট আটটি জাহাজে করে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। ভাসানচরে পৌঁছে সেখানকার পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন রোহিঙ্গারা।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বোট ক্লাব থেকে এক হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেয় নৌবাহিনীর জাহাজগুলো। দুপুর দুইটার পর জাহাজগুলো ভাসানচরে নোঙর ফেলে।
শুক্রবার ভাসানচরে যাওয়া একজন সৈয়দ উল্লাহ সেখানে পৌঁছে বার্তা সংস্থা ইএনবিকে বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমরা অত্যন্ত খুশি। আমি কখনোই ভাবিনি যে এত সুন্দর জায়গাটি, এত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।’
সৈয়দ তার আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবসহ বেশ কয়েকজনকে ফোন করেছেন যারা এখনো কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বসবাস করছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাদের কল করেছি। ভাসানচরে আসার পরে এটিই আমি প্রথম করলাম।’
সৈয়দ উল্লাহ বলেন, ‘কেউ আমাদের এখানে আসতে বাধ্য করেনি। আমি স্বেচ্ছায় এখানে এসেছি। এখানকার সুযোগগুলো দেখার পরে সবাই এখানে আসতে রাজি হবে। আমরা এখন আরও বেশি খুশি। সবাই এখানকার সুযোগ সুবিধা দেখে অনেক খুশি। আমরা যা ভেবেছি তার থেকে বেশি পেয়ে আমরা আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।’
সৈয়দ উল্লাহ কক্সবাজারের তুলনায় মসজিদ, আবাসন সুবিধাসমূহ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। তিনি ছাড়াও ভাসানচরে যাওয়া অনেক রোহিঙ্গাই গণমাধ্যমের কাছে তাদের সন্তুষ্টির কথা জানান।
কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির ও তার বাইরে অবস্থান নিয়ে থাকা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে নিয়ে নানা সামাজিক সমস্যা সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে দুই বছর আগে তাদের একটি অংশকে হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসানচরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। ১৩ হাজার একর আয়তনের ওই চরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হয়েছে ২৩১২ কোটি টাকা, যার পুরোটাই নিজস্ব অর্থায়নে ব্যয় করেছে সরকার। মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে আগেই ভাসানচরে নিয়ে রাখা হয়েছিল। এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলকে দেখার জন্য ভাসানচরে পাঠানো হয়। তারা ফেরার পর তাদের কথা শুনে রোহিঙ্গাদের একাংশ ভাসানচরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে বলে জানানো হয় সরকারি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে।
তবে সরকারের এ উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই জানিয়ে বুধবার বিবৃতি দিয়েছে জাতিসংঘ। তারা বলেছে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার যে পরিকল্পনা সরকার করেছে, তার সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই। ভাসানচরে যাওয়ার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গারা যেন সব তথ্য জেনে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তা নিশ্চিত করতেও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
অন্যদিকে সরকারের দাবি, ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য অবকাঠামোসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রথম দফায় যেসব রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেয়া হলো, তাদের জন্য খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীসহ অন্তত এক মাসের রসদ দ্বীপটিতে মজুত রাখা হয়েছে। কক্সবাজারে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জন্য এক বছরের রসদ মজুদ করা হবে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জন্য নানা ধরনের মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে দেশি-বিদেশি ২২টি সাহায্য সংস্থাকে যুক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে ওই সংস্থাগুলোর শতাধিক কর্মী এখন ভাসানচরে অবস্থান করছেন।
সমাজ কল্যাণ ও উন্নয়ন সংস্থার চেয়ারপারসন জেসমিন প্রেমা জানান, শুধু আগ্রহী রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে নেয়ার কাজ করছে সরকার এবং ২২টি উন্নয়ন সংস্থা। এসব রোহিঙ্গাকে জাহাজে ওঠার পূর্বে বিভিন্ন ডাটা এন্ট্রি সাপেক্ষে বরাদ্দকৃত আশ্রয়ণের টোকেন ও চাবি হস্তান্তর করা হয়।
সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য সেখানে মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর পালন করা হচ্ছে। আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাক-সবজি। পরীক্ষামূলকভাবে ধান চাষও করা হচ্ছে। প্রকল্পটিতে যেন এক লাখ এক হাজার ৩৬০ শরণার্থী বসবাস করতে পারেন সে লক্ষ্যে গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করা হয়েছে। ১২০টি গুচ্ছগ্রামে ঘরের সংখ্যা এক হাজার ৪৪০টি।
এদিকে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরে সরকারের আন্তরিক উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্ত বা অপব্যাখ্যা না করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সরকার।
শুক্রবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়ে বলেছে, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক এবং তাদের অবশ্যই মিয়ানমারে ফিরতে হবে। এ দেশে অস্থায়ী ভিত্তিতে আশ্রিত মিয়ানমারের এই নাগরিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তায় বাংলাদেশ সরকার নিজের সাধ্যমতো সবটুকু করছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান হলো তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। কাজেই এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিয়ে ও অর্থপূর্ণভাবে কাজ করাই হবে বাস্তবিক উদ্যোগ।
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি মিয়ানমারে দ্রুত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হওয়ার মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানায় বাংলাদেশ সরকার।