#১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডই বর্তমান ভাস্কর্য ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত: অ্যারোমা দত্ত।
#ভাস্কর্যবিরোধীদের কঠোর হস্তে দমন করতে হবে: সৈয়দ আহমেদ সেলিম।
#ইসলামিক দেশে যদি ভাস্কর্য থাকে, তাহলে বাংলাদেশে কেন নয়?: ড. মো. আনোয়ার হোসেন।
#স্বাধীনতা বিরোধীদের ঔরসজাত সন্তানরাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটূক্তি করার সাহস পাচ্ছে: ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া।
#ভাস্কর্য ও মূর্তি সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়: রেভারেন্ড রোনাল্ড দিলীপ সরকার।
সম্প্রতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন নিয়ে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী অনাহূত বিতর্কের সৃষ্টি করছে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের আস্ফালন দিন দিন বেড়ে চলেছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মাথাচাড়া দিতে দেয়া হবে না। আসলে মৌলবাদীদের টার্গেট ভাস্কর্য নয়, তাদের আসল টার্গেট বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১৭৮ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। শুক্রবার (০৪ ডিসেম্বর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য অ্যারোমা দত্ত, জার্মান আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক সৈয়দ আহমেদ সেলিম, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় চেয়ারম্যান ড. মো. আনোয়ার হোসেন, চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া, ঢাকা আঞ্চলিক ব্যাপটিস্ট চার্চ সংঘ, ঢাকা এর প্রধান পালক রেভারেন্ড রোনাল্ড দিলীপ সরকার। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
অ্যারোমা দত্ত বলেন, আমি প্রথমেই আপনাকে ও ভোরের পাতাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি আজকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের এই বিষয় নিয়ে সংলাপ আয়োজন করার জন্য। প্রথমত আমি এটার বিরুদ্ধে গভীরভাবে নিন্দা প্রকাশ করছি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিয়ে তাদের এতো বড় স্পর্ধা কিভাবে হয়। এই দেশে বসবাস করে, এই দেশের নাগরিক হয়ে সকল সুযোগ সুবিধা নিয়ে এই দেশের জাতির পিতাকে নিয়ে তাদের এতো বড় সাহস কি করে হলো। আজকে যখন আমরা বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী পালন করছি এবং ২০২১ সালে আমরা মুক্তিযুদ্ধের ৫০তম সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি সেসময় এই ইস্যুটা কেন টানা হবে। অবশ্যই এর পিছনে কোন না কোন ষড়যন্ত্র আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের ষড়যন্ত্রই কিন্তু বর্তমান ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনায় আজকে বাংলাদেশকে উন্নয়নে টয়টুম্বুর করে সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করেছেন, সেখানে আমি মনে করি এই জায়টাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যই তাদের এই প্রচেষ্টা হচ্ছে। বাংলাদেশের ধর্ম ব্যবসায়ীদের ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে অবস্থান আসলে বাংলাদেশ ও বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের বিরুদ্ধেই অবস্থান। পাকিস্তানপন্থী স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ধর্মভিত্তিক দল ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের আসল টার্গেট সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা। ৭৫ এর পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলার যে রাজনীতি শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধীতা সেই রাজনীতিরই অংশ। আমার এই জায়গাটা খারাপ লাগছে অনেক। যেখানে বঙ্গবন্ধু জাতী, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে গোটা বাঙ্গালির জাতির পিতা হিসেবে বিবেচিত সেখানে তাকে নিয়ে কেন এই ৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার নেপথ্যে যে সকল ষড়যন্ত্রকারীরা ছিল তারা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
সৈয়দ আহমেদ সেলিম বলেন, প্রকৃত অর্থে অনেক আত্মত্যাগের বিনিময়ে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে, যে স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে, সেই অর্জনটাকে গলাটিপে হত্যা করার জন্য স্বাধীনতার এই ৫০ বছরের সংলগ্নে এই ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে আবার। আমাদের মহান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তাকে সপরিবারে হত্যা করার পর যেসব ঘটনাগুলো ঘটেছে সেসব ঘটনা যেমন ষড়যন্ত্রের ইন্ধন ছিল ঠিক তেমনি আজ তার ভাস্কর্য নিয়ে আজ যা হচ্ছে তাই সেই ষড়যন্ত্রের অংশীদার বলা চলে। দেশে পবিত্র কোরআন-সুন্নাহবিরোধী কোনো আইন হবে না। তাই অন্য কোনো পথ না পেয়ে ধর্মীয় ইস্যুকে সামনে এনে সহনশীলতা বিনষ্টের অপচেষ্টা করা হচ্ছে, যা কঠোর হস্তে দমন করা হবে। ধর্মে যখনি রাজনীতি প্রবেশ করে তখন সেটা ধর্ম থাকেনা, অধর্ম হয়ে যায়। বাংলাদেশে ইসলামের নামে যে গণহত্যা হয়েছিল তার প্রতিবাদের আমরা জীবন হাতে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ধর্ম নিরপেক্ষতা, ধর্ম হীনতা নয়, এই বিষয়টাকেও নানাভাবে কুলষিত করে অপব্যাখ্যার মাধ্যমে এই দেশের সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্ত করা হয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীরা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। ‘৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশকে মিনি পাকিস্তান বানিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা স্বাধীনতা বিরোধীদের ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ বলেই আমি মনে করি।
ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি প্রথমে ভোরের পাতাকে ধন্যবাদ জানাই আজকের সংলাপের বিষয়টি নির্বাচন করার জন্য। আমি কিছু বলার পূর্বেই আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধে নিহত সকল শহীদ ও এই করোনাকালীন সময়ে যেসকল সম্মুখসারির যোদ্ধারা শহীদ হয়েছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরোধিতা করা দুরভিসন্ধিমূলক। বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্মান দেখানোর যে নাগরিক দায়িত্ব তাতে অন্তরায় সৃষ্টি করা সহ্য করা হবে না। এরা দেশ বিরোধী, স্বাধীনতা বিরোধী। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এদের প্রতিহত করা হবে। এসব সন্ত্রাসী রাজনীতির পরিপূরক হিসেবে তারা দেশে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনকে ধর্মীয় ইস্যু বানিয়ে আবার মাথা তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। তাদের কিছু সমাবেশ থেকে বলা হয়, ‘ঢাকার ধোলাইখালে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি (ভাস্কর্য) স্থাপন হবে সম্পূর্ণ ধর্মবিরোধী। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন। এটা বন্ধ করতে হবে। যদি বন্ধ করা না হয়, তাহলে আবারও তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্বরে জমায়েত হব।’ এটা রীতিমতো হুমকি। ঢাকার শাপলা চত্বরে সরকারবিরোধী সমাবেশ ঘটিয়েছিল হেফাজত। আবার এই যে শাপলা চত্বর ঘটানোর হুমকি দিচ্ছে তারা। আমরা জানি যে, এই বিষয়ে অনেক মাতামাতি করছে, তারা যাদেরকে মুরব্বী মনে করে সে সমস্ত দেশেও কিন্তু ভাস্কর্য আছে। পৃথিবীর অন্যতম ইসলামি দেশ বলা হয় ইরান। সেই ইরানের উদাহরণ দিয়ে যদি আমি বলি তাহলে অনেক কিছুই বের হয়ে আসবে এখান থেকে। সেই ইরানের যিনি বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন সেই খোমেনীর ভাস্কর্য কি ইরানে নেই? ইসলামি দেশে যদি সেই দেশের প্রতিষ্ঠাতার ভাস্কর্য থাকে তাহলে বাঙালি জাতিকে যিনি মুক্তি দিলেন, যিনি এই স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছিলেন তার ভাস্কর্য হলে তো আমি এখানে দোষনীয় কিছু দেখছি না।
ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতির পিতা এটা আমরা সবাই জানি। তিনি আমাদের অসীম সাহস ও আত্মবিশ্বাসের ভাণ্ডার। এই বঙ্গবন্ধুই কিন্তু ১৯৭১ সালের পাকিস্তান নামক দানবীয় রাষ্ট্রের কাছেও কিন্তু মাথা নত করেননি। তারা আমাদের জাতির পিতাকে কোনভাবেই দমন করাতে পারেনি। তিনি তার অসীম সাহস নিয়ে, আত্মবিশ্বাস নিয়ে সংগ্রাম করে বাঙালি জাতির জন্য দেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এই স্বাধীন দেশের একক নেতা যদি বলা হয় তিনি আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই স্বাধীন দেশের স্রষ্টা নিয়ে তারা যখন এইসব কথা বলছেন তাদের প্রথমেই তার প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত কারণ এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই তারা আজ বড় বড় আলেম হয়ে বিভিন্ন পদবী লাগিয়ে সারা বাংলাদেশে অনেক বড় বড় ওয়াজ মাহফিল করে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে মুজিব শতবর্ষে কেন এই ধরণের কটূক্তি করা হচ্ছে? তারা এই সাহস কোথা থেকে পাচ্ছে? এর গভীরে যদি আমরা যায় তাহলে দেখতে পাবো যারা এইসব করছেন তারা ১৯৭১ এর স্বাধীনতা বিশ্বাস করেনি এবং তাদের পূর্বসূরিরা, তারা ৫২ এর ভাষা আন্দোলন বিশ্বাস করেনি এবং তাদের পূর্বসূরিরা, তাদের ঔরসজাত সন্তান যারা রয়েছে, তারাই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আজ কটূক্তি করার সাহস পাচ্ছে। একাত্তরের স্বাধীনতার সেই ষড়যন্ত্রকারীরা আজও রয়ে গেছে। সুতরাং আমরা যারা এই স্বাধীনতার সপক্ষের লোকেরা আছি তাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে এদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে।
রেভারেন্ড রোনাল্ড দিলীপ সরকার বলেন, আজকে লাইভে আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য কর্তৃপক্ষ সহ আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে আমার বক্তব্য শুরু করতে যাচ্ছি। যুদ্ধের স্মৃতি আমার মনে আছে। সেসময় দেখেছি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য বাংলার মানুষের মধ্যে যে একতা, প্রেম, ভ্রাতৃত্ব ছিল। যার কারণে সমস্ত জাতি তখন একত্র হয়ে বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। তৎকালীন সময়ে কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ কে বা খ্রিস্টান এটা তখন মূল বিষয় ছিলোনা। মূল বিষয় ছিল বাংলার স্বাধীনতা। ভাস্কর্য নিয়ে আমি যদি বলি তাহলে বলতে হবে বহু দেশে বহু মুসলমান রয়েছেন, যারা ভাস্কর্য শিল্প অনুমোদন করেন, নিজের ঘরে সজ্জাবস্তু হিসেবে রাখেন, মিউজিয়ামে পবিত্র স্মৃতি উপকরণ হিসেবে যত্ন সহকারে সেগুলো সংরক্ষিত থাকে, ছুটির দিনে দল বেঁধে অনেক মুসলমান তা দেখতে যান। সেসব নিয়ে মুসলিম পণ্ডিতরা ইতিহাসের পাঠোদ্ধার করার জন্য বিচিত্র গবেষণা ও প্রত্নতত্ত্ব বিদ্যা চর্চা করেন। কিন্তু আমাদের দেশে সব অন্ধত্ব যেন এদের ভর করছে কয়েক যুগ ধরে। সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের মহান বাণী পৌঁছানোর, ইসলামকে সঠিকভাবে সবার সামনে রিপ্রেজেন্ট করার পরিবর্তে এরা মেতে আছে ঠুনকো সব ইস্যু নিয়ে। ভাস্কর্য আর মূর্তি এই দুইটির ইংলিশ শব্দের অর্থ পুরটাই ভিন্ন। ইংরেজিতে ভাস্কর্য হচ্ছে স্কাল্পচার আর মূর্তি হচ্ছে আইডল, ফিগার, আইকন। মূর্তির বাংলার অর্থ দাড়ায় উপসস বস্তু, ঠাকুর, ভক্তির মূর্তি, দেব মূর্তি। আর ভাস্কর্যের বাংলা অর্থ দাড়ায় মানব মূর্তি, শিলা রুপ মূর্তি, বা মাটি দিয়ে নির্মিত বস্তু। মূর্তি হচ্ছে যাকে ভক্তি করা হয় আর ভাস্কর্য হচ্ছে আপনি যাকে ভালোবাসার একটি পাত্র যাকে আমি পছন্দ করতে পারি। তাই এখানে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয়।