সুপার ম্যানের মতোই এসেছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। ঢাকাকে সুপরিকল্পিত নগরায়নের মাধ্যমে ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত শহরে রূপান্তর করার জন্য তিনি নিয়েছিলেন একগুচ্ছ পরিকল্পনা। তার মৃত্যুর পর সে পরিকল্পনাগুলোর অধিকাংশই আর বাস্তব রূপ লাভ করেনি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড তিনি উচ্ছেদ করেছিলেন, তার মৃত্যুর কিছুদিনের মধ্যেই সেই ট্রাকস্ট্যান্ড ফের দখলে নিয়েছে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের চালক ও মালিকরা। তবে রাজধানীর গণপরিবহনকে সুশৃঙ্খল করার জন্য ‘বাসরুট রেশনালাইজেশন’ নামে যে পরিকল্পনা নিয়ে আনিসুল হক নিয়েছিলেন, ৫ বছর পর হলেও সে পরিকল্পনা অবশেষে আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে।
আনিসুল হকের পরিকল্পনায় ছিল রাজধানীর সব বাস ৬টি বড় কোম্পানির আওতায় আসবে এবং শতাধিক রুটের পরিবর্তে ২২টি রুটে চলাচল করবে। ছয়টি বাস কোম্পানির বাসের রঙ হবে- কমলা, নীল, মেরুন, গোলাপি, বেগুনি ও সবুজ। ২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে বাসরুট রেশনালাইজেশন ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা পদ্ধতি প্রবর্তনের বিষয়ে আনিসুল হক যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে বাসরুট রেশনালাইজেশন করার জন্য ১০ সদস্যের একটি কমিটি করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। এরপর কমিটি বাস্তবতা সমীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য পরামর্শক নিয়োগ করে। দীর্ঘ দুই বছরের বেশি সময় ধরে সমীক্ষা করে কমিটি এ বছরের ১০ নভেম্বর প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটির সুপারিশ প্রসঙ্গে বাসরুট রেশনালাইজেশন কমিটির সভাপতি ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ‘এ সংক্রান্ত পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক প্রতিবেদন আমরা পর্যালোচনা করছি। আগামী বছরের মধ্যেই বাসরুট রেশনালাইজেশন কার্যক্রম দৃশ্যমান হবে।’ দেরিতে হলেও আনিসুল হকের এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে, তবে উচ্ছেদ করা তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড আবারও সেই পুরানো রূপে ফিরে গেছে। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড, মহাখালী বাস টার্মিনালের সামনের রাস্তা ও তেজগাঁও শিল্প এলাকার সড়কগুলো আবারও দখলে নিয়েছে বাস-ট্রাক, পিকআপ-ভ্যান চালকরা। সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে কোথাও এক লাইন, কোথাও দুইলাইন করে পার্কিং করে রাখা হয়েছে শতশত ট্রাক ও বাস। এর ফলে সড়কের দু’পাশে আবারও নতুন করে গাড়ির জট সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভোগান্তি হচ্ছে সে রাস্তায় চলাচলরত যানবাহনের। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ওই সড়ক ও আশপাশের সড়কগুলো অবৈধ দখলমুক্ত করে। এ সময় ট্রাক রাখার জন্য তেজগাঁওস্থ রেলওয়ের খালি জায়গা নির্ধারণ করে দেয় ডিএনসিসি। সড়ক বিভাজক দিয়ে লাগানো হয় গাছ। ফুটপাথ সংস্কার করে হাঁটার উপযোগী করা হয়। কিন্তু এখন ট্রাক রাখার কারণে ফুটপাথ ঢাকা পড়ে গেছে। এর বেশিরভাগ জায়গা দিয়ে চলাচলেরও উপায় নেই।
একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডটি দখলে রেখে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিকদের একটি সিন্ডিকেট প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছে। মূলত সিন্ডিকেটির বড় একটি উপার্জনের জায়গা এই স্ট্যান্ডটি। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক যখন এই স্ট্যান্ড উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তখন তাকে নানা হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল। এমনকি স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে গেলে রক্তারক্তির ভয় পর্যন্ত দেওয়া হয়েছিল তাকে। তার দৃঢ় অবস্থান এবং সাহসী পদক্ষেপের কারণে উচ্ছেদ ঠেকাতে পারেনি সিন্ডিকেটটি। কিন্তু তার মৃত্যুর পর ওই সিন্ডিকেট প্রভাব খাটিয়ে আবার দখলে নিয়েছে স্ট্যান্ডটি।
গতকাল সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেল লাইন পর্যন্ত সড়কটিতের দুপাশে লাইন করে কাভার্ড ভ্যান ও ট্রাক ও পিক-আপ রাখা হয়েছে। এর ফলে মূল সড়ক হয়ে পড়েছে সংকুচিত। এখানে অবস্থতি বাংলাদেশ জরিপ অধিদফতরের মুখও সকাল থেকে ট্রাকের জটে আটকে থাকে। এছাড়া সিএসডি গুদামের ২ নম্বর গেট, সিএসডি ভাঙা গেট মোড় হয়ে পুরানো এফডিসি সড়কের পুরোটাই দখলে চলে গেছে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের। এসব পথে অন্য কোনো যানবাহন চলাই দায়। সাতরাস্তা থেকে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটের পাশ দিয়ে দক্ষিণ বেগুনবাড়ি যাওয়ার সড়কেও একই অবস্থা। এ সড়কের অর্ধেকের বেশি অংশ ছোট ট্রাকের দখলে থাকে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়ছে পথচারি ও রিকসাযাত্রীরা।
ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রুস্তম আলী খান অবশ্য বলছেন, প্রতিদিন কারওয়ান বাজার, সিএসডি গোডাউন, কেন্দ্রীয় ওষুধ গুদাম, বিজিপ্রেস ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রির আড়াই থেকে তিন হাজার গাড়ির মালামাল লোড আনলোড হয়। লোড আনলোডের সময় এখানকার রাস্তা ব্যবহার ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এছাড়া, তেজগাঁও ট্রাক স্ট্যান্ডে প্রতিদিন ছয় হাজারের বেশি গাড়ি চালান নেওয়ার জন্য আসে। অথচ এ স্ট্যান্ডে সর্বোচ্চ দেড় থেকে দুই হাজার গাড়ি রাখার জায়গা আছে। ফলে উপায়ন্ত না দেখেই গাড়িগুলো সড়কে পার্ক করে রাখা হয়।
এ ব্যাপারে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম জানান, তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের জায়গাটি সিটি করপোরেশনের নয়। এটি রেলওয়ের জায়গা। তিনি বলেন, ‘তবে সাতরাস্তার মোড় থেকে কারওয়ান বাজার সড়কসহ আশপাশের সড়ক ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান পার্কের জন্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে রাস্তাগুলোর দিকে ঠিকমতো নজর দেওয়া হয়নি। তবে শিগগিরই এগুলো দখলমুক্ত করা হবে।’ তিনি জানান, আমিনবাজারেও সিটি করপোরেশনের একটি ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান স্ট্যান্ড রয়েছে। সেখানে বাউন্ডারি দেয়াল তুলে চালকদের বিশ্রামগারও রাখা হয়েছে। এভাবে অন্যান্য স্ট্যান্ডগুলোকেও সংস্কার করা হবে। তখন সেখানে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান পার্ক করা যাবে।