প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:১৪ এএম আপডেট: ০৪.১২.২০২০ ১:৩১ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
বিজয় মাসের এইদিনে দুর্বার গতিতে গেরিলা কৌশলে এগুতে থাকে মুক্তিবাহিনী। মুক্ত করতে থাকে একের পর এক গ্রাম। নিজেদের পরাজয় বুঝতে পেরে পিছু হটতে থাকে পাকবাহিনী ও তাদের দোসর আল বদর, আল শামস, রাজাকারবাহিনী। তীব্র শীত উপেক্ষা করে জলে স্থল অন্তরীক্ষে লড়তে থাকে মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনীর কৌশল ছিল পাঁচটি। প্রথমত:গ্রামাঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করা। দ্বিতীয়ত:পাকবাহিনীর ঘাঁটিগুলোকে চিহ্নিত করে ধ্বংস করা। তৃতীয়ত:ধীরে ধীরে শহরগুলোকে মুক্ত করে ঢাকার দিকে এগিয়ে যাওয়া। চতুর্থত:বিমান হামলার মাধ্যমে পাকবাহিনীকে বিভ্রান্ত করা।
পঞ্চমত:নৌবন্দরগুলোতে নৌ হামলার মাধ্যমে নৌ যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং সাধারণ নাগরিকদের ক্ষয় ক্ষতির বাইরে রেখে তাদের সহযোগিতায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া। মুক্তিবাহিনী মুক্তাঞ্চলগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করায় পাকিস্তানিবাহিনী বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তার উপর গোলাবর্ষণের বহর দেখে দিকভ্রান্ত হয় পাকসেনারা। মূল সড়কগুলোতে টহল বাড়াতে থাকে তারা।
একমাত্র কুষ্টিয়া ছাড়া বাকি সীমান্তগুলোতে তল্লাসী শুরু করে। দর্শনায় ৪নং পার্বত্য ডিভিশনের কামান হামলার পর সেখান থেকে পিছু হটতে থাকে তারা। মুক্তিবাহিনীর বীরত্বে দখলদার মুক্ত হতে থাকে- দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, গাইবান্ধার ফুলছড়ি, দামুড়হুদা, জীবননগর, বকশীগঞ্জ, লক্ষ্মীপুরসহ আরও কিছু এলাকা। রাতে দেওয়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বেতার ভাষণে স্পষ্ট হয় বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন। পাক সরকারও দিশেহারা হয়ে শুরু করে নতুন এক যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক স্নায়ু যুদ্ধ। আন্তর্জাতিক এই স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয় জাতিসংঘে। পাকিস্তান সরকার চাচ্ছিলো এই যুদ্ধকে পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে দেখিয়ে নয়া নোংরা কূটনৈতিক কৌশল চালানো। যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কাজে লাগানোই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে করতে চেয়েছিল দুর্বল। নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আনে পাকিস্তানের অনুরোধে। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উপস্থাপন করেন সিনিয়র জর্জ বুশ। তার দাবি ছিল পাক-ভারত সীমান্তের সৈন্য প্রত্যাহারের। দীর্ঘ বৈঠকের পরও নিরাপত্তা পরিষদে পাস হতে পারেনি এই প্রস্তাবটি। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার লিখিত এক পত্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য অনুরোধ করে ইন্দিরা গান্ধীকে।
প্রতিটি দেশপ্রেমিক মুসলমান প্রেসিডেন্টের পেছনে রয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আশ্বাস দেন স্বাধীনতাবিরোধী সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর আমীর মাওলানা আবুল আলা মওদুদী। দুপুরে ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ঘোষণা করেন আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের। রাওয়ালপি-িতে একজন সরকারি মুখপাত্র বলেন, পাক সীমান্ত যুদ্ধ চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় মোকাবিলা করা হচ্ছে ভারতীয় চাপ। পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেবে চীন। ইসলামাবাদকে দৃঢ় সমর্থন দেওয়ার অঙ্গীকার করেন চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি পেং ফেই। যৌথবাহিনীর তিনটি ডিভিশন যশোর, পঞ্চগড় ও চুয়াডাঙ্গা দিয়ে এগোতে থাকে ঢাকার অভিমুখে। এদিকে ৪ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল সি আর দত্ত এবং জেড ফোর্সের মেজর জিয়াউদ্দিনের নেতৃত্বে সিলেটের কানাইঘাট দখলের পর এলাকায় শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করে মুক্তিবাহিনী। পাক বিমান বাহিনীর দুই স্কোয়াড্রন (২৮টি) জঙ্গি বিমান, এক স্কোয়াড্রন চীনা মিগ-১৯ আর এক স্কোয়াড্রন মার্কিনী স্যাবার জেট ধ্বংস করে মুক্তিবাহিনী।
(তথ্যসূত্র- স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র, মূলধারা’৭১)