প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:১৪ এএম আপডেট: ০৪.১২.২০২০ ১:৩২ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থেকে বিপুল অর্থ, অস্ত্র-মদসহ গ্রেফতার মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে আট বছর আগে ‘অবৈধ সম্পদ’ অর্জনের অভিযোগে করা মামলায় অভিযোগপত্র অনুমোদন করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এদিকে, গোল্ডেন মনিরের তিন মামলায় ফের ৯ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার দুজন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট পৃথক আদেশে এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। কমিশনের পরিচালক (জনসংযোগ) প্রনব কুমার ভট্টাচার্য্য জানান, গতকাল বৃহস্পতিবার অনুমোদন পাওয়া এই অভিযোগপত্রে মনিরের বিরুদ্ধে তিন কোটি ১০ লাখ ৮৫ হাজার ৩৩৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। শিগগিরই এ অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হবে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মনির তার সম্পদের হিসাবে এক কোটি ৬১ লাখ টাকার সম্পদ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে দান হিসেবে পাওয়ার ‘ভুয়া তথ্য’ দিয়েছেন। এছাড়া আরও এক কোটি ৪৯ লাখ ৮৫ লাখ ৩৩৫ টাকার সম্পদের তথ্য তিনি হিসাব বিবরণীতে দিয়েছেন, যার কোনো বৈধ উৎস দুদকের তদন্তে ‘পাওয়া যায়নি’ বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে। ২০১২ সালের ১৩ মার্চ ঢাকার রমনা মডেল থানায় মনিরের বিরুদ্ধে এই মামলা করে দুদক। তার আগে তার সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস পাঠানো হয়। সেই নোটিস পেয়ে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সম্পদের হিসাব কমিশনে জমা দেন মনির। পরে হাইকোর্টে এ বিষয়ে একটি রিট মামলার কারণে দুদকের তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। তদন্ত শেষ হতে আট বছর সময় লাগার কারণ ব্যাখ্যা করে দুদক কর্মকর্তা প্রনব বলেন, ‘উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ ছিল। এরপর কমিশনের এক সহকারী পরিচালককে মামলা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই কর্মকর্তাও বদলি হয়ে যাওয়ায় তদন্ত কার্যক্রম বিলম্বিত হয়।’ পরে দুদকের উপ পরিচালক মোশাররফ হোসেন মৃধা মামলাটি তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেন, যা বৃহস্পতিবার কমিশনের অনুমোদন পেল। মনিরের বিরুদ্ধে আরেকটি অনুসন্ধান চলছে জানিয়ে প্রনব বলেন, ‘২০০৯ সালের পর থেকে তার অর্জিত অবৈধ সম্পদের বিষয়ে এ অনুসন্ধান চলছে। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে মনির ও তার স্ত্রী রওশন আক্তারের সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিস পাঠানো হয়েছে। নতুন এই অনুসন্ধানে তার প্রচুর অবৈধ সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে।’ দুদক পরিচালক আকতার হোসেন আজাদের স্বাক্ষরে গত ২৬ নভেম্বর পাঠানো ওই নোটিসে মনির ও তার স্ত্রীকে ২১ কার্যদিবসের মধ্যে সম্পদের বিবরণী দাখিল করতে বলা হয়েছে। মেরুল বাড্ডায় মনিরের ছয়তলা বাড়িতে গত ২০ নভেম্বর রাতে অভিযান চালায় র্যাব। অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানে এই অভিযান চালানোর পর মনিরকে গ্রেফতার করা হয়। অভিযানে মনিরের বাড়ি থেকে নগদ এক কোটি নয় লাখ টাকা, চার লিটার মদ, আট কেজি সোনা, একটি বিদেশি পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারের পর মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে তিনটি মামলা হয়েছে। মামলাগুলো তদন্ত করছে গোয়েন্দা পুলিশ। র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যবসা নয়, কার্যত ‘সোনা চোরাচালানই’ ছিল মনিরের ব্যবসা; পরে তিনি জড়িত হন জমির ব্যবসায়। এক সময় নিউ মার্কেট এলাকায় মনিরের একটি সোনার দোকান ছিল। ‘স্বর্ণ চোরাচালান’ ব্যবসার সময় তিনি ‘গোল্ডেন মনির’ নামে পরিচিতি পান। তবে ২০০১ সালের পর এই ব্যবসা গুটিয়ে জমির ব্যবসায় মন দেন। মনিরের বাড়িতে পাঁচটি গাড়ি পাওয়া গেছে, যার মধ্যে তিনটি গাড়ির বৈধ কাগজপত্র নেই বলে সেগুলো জব্দ করেছে র্যাব। তার এক হাজার ৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছে র্যাব। বাড্ডা, নিকেতন, কেরানীগঞ্জ, উত্তরা ও নিকুঞ্জে দুইশর বেশি প্লট রয়েছে তার। রাজউকের সিল নকল করে ভূমি দখলের অভিযোগেও একটি মামলা রয়েছে মনিরের বিরুদ্ধে।
এদিকে, গত ২২ নভেম্বর এসব মামলায় তার ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়। তবে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় সাত দিনের পৃথক রিমান্ড একত্রে চলমান থাকায় ১১ দিনে শেষ হয় এই রিমান্ড। প্রথম দফা রিমান্ড শেষে গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে হাজির করে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১০ দিন করে রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার পরিদর্শক (অপারেশন) ইয়াসীন গাজী। অপরদিকে একইদিনে মাদক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার উপ-পরিদর্শক জানে আলম দুলাল ৫ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মইনুল ইসলাম অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় তিন দিন করে ৬ দিন এবং মাদক মামলায় অপর মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশীদ তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে অস্ত্র ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুই মামলার রিমান্ডের আদেশ পৃথক হলেও জিজ্ঞাসাবাদ একত্রে চলবে। রাষ্ট্রপক্ষে মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আবদুল্লাহ আবু রিমান্ড আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন। আসামিপক্ষে আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী রিমান্ড বাতিলের আবেদন করেন। শুনানি শেষে বিচারক এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন। গত ২১ নভেম্বর সকালে রাজধানীর বাড্ডা এলাকার নিজ বাসা থেকে গোল্ডেন মনিরকে আটক করা হয়। এ সময় তার বাসা থেকে ৬০০ ভরি সোনার গহনা, বিদেশি পিস্তল-গুলি, মদ, ১০ দেশের বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা ও নগদ এক কোটি নয় লাখ টাকা জব্দ করা হয়। এছাড়া, তার বাড়ি থেকে অনুমোদনহীন দু’টি বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়, যার প্রতিটির বাজারমূল্য প্রায় তিন কোটি টাকা। তার ‘অটো কার সিলেকশন’ নামের গাড়ির শোরুম থেকে আরও তিনটি অনুমোদনহীন বিলাসবহুল গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। র্যাব জানায়, ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় দুই শতাধিক প্লট ও ফ্ল্যাটের মালিক গোল্ডেন মনির। রাজউকের কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে জালিয়াতির মাধ্যমে অসংখ্য প্লট হাতিয়ে নেন তিনি। তবে প্রাথমিকভাবে ৩০টি প্লট ও ফ্ল্যাটের কথা স্বীকার করেছেন মনির।
একটি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে এ অভিযান চালানো হয়। এর আগেও গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এবং রাজউকের একটি মামলা রয়েছে। মনির মূলত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী ও স্বর্ণের চোরাকারবারি। এ থেকেই মনির পরিচিতি পান ‘গোল্ডেন মনির’ হিসেবে। গত ২১ নভেম্বর আটক করার পর র্যাব-৩ কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া গোল্ডেন মনিরকে বাড্ডা থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় র্যাব বাদী হয়ে মনিরের বিরুদ্ধে অস্ত্র, বিশেষ ক্ষমতা ও মাদক আইনে তিনটি মামলা দায়ের করে।