প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:১৪ এএম আপডেট: ০৪.১২.২০২০ ১:৩২ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
মার্চে যখন দেশে করোনার প্রথম সন্ধান মেলে তখন সাধারণের ভেতরে এই রোগটি প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিয়ে চলাচল করতে দেখা গেছে। রোগ শনাক্তের প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব রুখতে দেশজুড়ে লকডাউন চালু করে সরকার। এই ব্যবস্থায় সুফলও মেলে। যদিও লকডাউন নিয়ে নেতিবাচক কথাবার্তা থেমে থাকেনি। অনেকেই লকডাউনকে সরকারের বাড়াবাড়ি একই সঙ্গে নাগরিক অধিকারের নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে অভিযোগ করতে থাকে। লকডাউনে পরিস্থিতি অনেকটাই অনুকূলে আসায় ধীরে ধীরে সরকার তা তুলে নেয়।
সরকারের এই শিথিল অবস্থানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাধারণ মানুষের ভেতরে সুরক্ষার বিষয়টি ধীরে ধীরে উঠে যেতে থাকে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে মনগড়া ধারণা নিয়ে মানুষকে অবাধে চলাচল করতে দেখা যায়। এসময় ভয়ের বিষয়টি জনগণের ভেতর থেকে সরে যেতে শুরু করে। এরপর আসে মুসলমানদের পবিত্র ঈদ। তখন সারা রাস্তা সরকারি নির্দেশে বন্ধ থাকলেও প্রশাসনের সহায়তায় ব্যক্তিগত গাড়ি, ভাড়ার গাড়ি প্রভৃতি যানে করে বেশিরভাগ মানুষই প্রিয়জনদের সঙ্গে মিলতে নগর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি জমায়। শহর থেকে যাওয়া লোকজন গ্রামেও এই ভাইরাসটি রফতানি করে। যারা খেসারত স্পষ্ট হয় ঈদের পর হঠাৎ করেই কমিউনিটি পর্যায়ে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া। সবধরনের কড়াকড়ির বাঁধন শিথিল করে দেওয়ায় জনসাধারণের ভেতরে ভাইরাসটির বিষয়ে অনেকটা উপেক্ষার ভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বর্তমানে সেই ধারাটি কমবেশি অক্ষুণœ থাকায় ভাইরাসটি অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করতে চলেছে। গত মে এবং জুন জুলাই মাসে শনাক্তের সংখ্যা বেশি ছিল। এরপর আগস্ট এবং সেপ্টেম্বরে এসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমতে থাকে। এসময় সবকিছু স্বাভাবিক করে দেওয়া হয়। হোটেল রেস্তেরাঁ যেমন খুলে দেওয়া হয় তেমনি শপিংমল , যানবাহন সব কিছুই সরকার শর্তসাপেক্ষে খুলে দেন। এসময় যানবাহনে একটি সিট খালি রেখে মুখে মাস্ক এবং সমাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলাচলের অনুমতি দেয়। যানবাহনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ষাট শতাংশ পর্যন্ত ভাড়া বাড়ানো হয়। এভাবে মাস দুয়েক চলাচলের পর সরকার আবার সব কিছু স্বাভাবিক করতে পরিবহনসহ ব্যবসা বাণিজ্য শপিংমল খুলে দেন। যদিও তখন নির্দেশনা দেওয়া হয়, স্বাস্থ্যবিধি মেনে এই সব কর্মকা-ে অংশ নেওয়া যাবে। কিন্তু সরকারের সেই নির্দেশাবলী কতটুকু পালিত হচ্ছে সেবিষয়ে কোন জবাবদিতিা না থাকায় রোগটি হঠাৎ করেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এখন গাদাগাদি করে পরিবহনে যাত্রী উঠানো হচ্ছে। বেশিরভাগ যাত্রী মাস্ক বা স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। একই চিত্র শপিং মলে বা বাজার ঘাটে। ধাক্কা ধাক্কি করে মালামাল কেনার প্রতিযোগিতা চলছে। ফলে ভাইরাসটি অতীতের সব রেকর্ড ভাঙতে শুরু করেছে। মাত্র গত মাসে প্রায় কয়েকশ যেমন মৃত্যু যেমন হয়েছে তেমনি কয়েক হাজার লোক করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত করোনা শনাক্ত নিম্নমুখী থাকলেও এরপর থেকে আবারও শনাক্ত ওপরের দিকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি এখন আর শীত নির্ভর নয় বরং বায়ু দূষণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সামনে সংক্রমণ আরও বাড়বে। কারণ বায়ু দূষণের সঙ্গে বক্ষব্যাধির সম্পর্ক আছে এবং তাতে করোনার ঝুঁকি থাকে বেশি।
করোনার তুলনামূলক চিত্র :দেশে করোনায় এখন পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ৪ লাখ ৬৯ হাজার ৪২৩ জন। এছাড়া এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৬ হাজার ৭১৩ জন। গত অক্টোবর মাসে মোট শনাক্ত ছিল ৪২ হাজার ৮৬৯ এবং নভেম্বর মাসে ৫৬ হাজার ২৩৭ জন। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে শনাক্ত বেড়েছে ১৩ হাজার ৩৬৮ জন। অন্যদিকে অক্টোবরে মৃত্যু ছিল ৬৩৬ এবং নভেম্বরে ৭০৯ জন। অর্থাৎ মৃত্যু ৭৩ জনের বেশি হয়েছে অক্টোবরের তুলনায়। পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, দেশে এখন পর্যন্ত কোভিড সংক্রমণ নিয়ে একমাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটেছিল জুন মাসে ৬৪ জন। ওই মাসে এক হাজার ১৯৭ জন কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জুলাইতে মোট মৃত্যু ছিল ১ হাজার ২৬৪ জন। আগস্টে এই সংখ্যা কিছুটা কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৯৮ জনে।
নভেম্বরের শেষ ১৫ দিনে শনাক্ত ৬২ শতাংশ :দেশের করোনার পরিসংখ্যান বলে, সর্বশেষ ৭ সেপ্টেম্বর ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত ছিল ২ হাজারের কিছুটা বেশি। এরপর আর ২ হাজারের ঘর করোনা শনাক্ত ছুঁতে পারেনি। এর ৭১ দিন পর ১৬ নভেম্বর আবারও করোনার শনাক্ত দাঁড়ায় ২ হাজারের ঘরে। এদিন শনাক্ত হয় ২ হাজার ১৩৯ জন। এরপর দিন আরেকটু বেড়ে শনাক্ত দাঁড়ায় ২ হাজার ২১২ জন। এরপর শুধু ১৫ দিন মোট শনাক্ত হয় ৩৪ হাজার ৮৯২ জন। অর্থাৎ এই কয়দিন গড়ে ২ হাজার ৩২৬ জন শনাক্ত হয়েছে। আর পুরো মাসে শনাক্ত হয়েছে ৫৬ হাজার ২৩৭ জন। অর্থাৎ পুরো মাসের ৬২ শতাংশই শনাক্ত হয় শেষ ১৫ দিনে।
ঊর্ধ্বমুখীতার কারণ :দেশে করোনা সংক্রমণের হার আগস্টের পর থেকে স্থিতিশীল হলেও নভেম্বরে তা হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে। নভেম্বরের শুরুতে হার ছিল ১৩ দশমিক ৪৭ এবং শেষে হার ১৪ দশমিক ৭৯। তবে এই হার সম্প্রতি ১৬ শতাংশ অতিক্রম করেছে। এবিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা চলতি মাসেই সংক্রমণ বাড়বে। তবে অনেকেই আবার এই মতের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে,এটা আগে থেকে বলা খুব কঠিন। জ্যেষ্ঠ জনস্বাস্থ্যবিদ ড. আবু জামিল যেমনটি বলছিলেন। ‘করোনা সংক্রমণ সামনে আরও বাড়বে। নভেম্বরের কিছুটা উঠানামা হয়েছে কিন্তু বাড়তির দিকেই তো আছে। সংক্রমণ এই মুহূর্তে বাড়ার দিকেই আছে। শীতকাল এক্ষেত্রে একমাত্র কারণ নয়, এসময় আমাদের সবচেয়ে বড় রিস্ক হল ধূলিকণা। করোনা না থাকা অবস্থায় বিগত বছরে বায়ু দূষণের কারণে এই সময়ে অনেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে। যারা বয়স্ক যাদের হাঁপানি ছিল তাদের অবস্থা খুব খারাপ হয়েছে। হাঁপানি, ব্রংকাইটিস এগুলো হচ্ছে রিস্ক ফ্যাক্টর করোনার ক্ষেত্রে। তাই এখানে আরও করোনা আক্রান্ত বাড়লে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’ আইইডিসিআর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন জানালেন, পৃথিবীর অন্যান্য অংশে যখন মহামারিটি আছে, তখন এখানেও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তেবে কেবল শীতকাল কিংবা গ্রীষ্মকাল নয় সবসময়ই আশঙ্কা রয়েছে। তার মতে, দূষণ আমাদের এখানে গ্রীষ্মকালেও থাকে। শীতে সমস্যা হল এলার্জির কারণে অনেকের সর্দি কাশি হয়, তার সঙ্গে করোনার সংক্রমণ হলে ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। তাছাড়া সামাজিক অনুষ্ঠানের কারণে মেলামেশা বেশি হয়। তাতেও বাড়তে পারে সংক্রমণ। তারপরেও মানুষের ভেতরে উদাসীনতা এবং অবহেলা ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখছে।