প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:১৪ এএম আপডেট: ০৪.১২.২০২০ ১:৩১ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ
নানা দোলাচল ও অনিশ্চয়তা শেষে অবশেষে ভাসানচরে রওনা দিয়েছে রোহিঙ্গাদের প্রথম দল। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় উখিয়া ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে প্রথম দফায় ১০টি বাস এবং বেলা পৌনে ১টার দিকে আরও ১৩টি বাসে করে ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দেয় মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা এসব শরণার্থী। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া না গেলেও রোহিঙ্গা স্থানান্তরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ রোহিঙ্গা স্থানান্তরের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে আমরা শুধু নিরাপত্তার দায়িত্বটুকু পালন করছি। এ ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে পারবেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার’।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভাসানচরে স্থানান্তরের জন্য গত বুধবার রাতেই উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প সংলগ্ন ঘুমধুম ট্রানজিট ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয় একদল রোহিঙ্গাকে। রাতেই উখিয়া ডিগ্রি কলেজ ক্যাম্পাসে জড়ো করা হয় বেশ কিছু বাস। সকাল থেকে কয়েকশ রোহিঙ্গা নর-নারী ভর্তি বাসগুলো উখিয়া কলেজ ক্যাম্পাস ছাড়তে শুরু করে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ আশ্রিত ৩৪ ক্যাম্প থেকে আগ্রহী রোহিঙ্গাদের নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসনচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বেশ কিছুদিন ধরেই। গতকাল ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যদিয়ে তাদেরকে বিশেষ পরিবহণে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ভাসানচরের উদ্দেশে। সকাল থেকে মোট ২৩টি বাস ছেড়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ভোরের পাতা প্রতিনিধি মোহাম্মদ শফিক। তিনি স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, প্রতিটি বাসে ৩০ থেকে ৪০ জনের মতো রোহিঙ্গা রয়েছে। বুধবার রাতের মধ্যেই ৬শ পরিবারের ২ হাজার ৫শ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়ার কথা জানতে পারেন তিনি। এভাবে আজ শুক্রবার আরো সাড়ে ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নেওয়া হবে। উখিয়া থেকে বাসে করে প্রথমে রোহিঙ্গারা যাবে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে আজ সাগরপথে ভাসানচরে যাবে। এজন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে নৌবাহিনীর ১৪টি জাহাজ। নিশ্চিত করা হয়েছে তাদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা। এভাবে পালাক্রমে এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ১ লাখ ১ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনা, পুলিশ ও উগ্রবাদীদের হাতের হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত আট লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে থেকে দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে এবং ক্যাম্পের বাইরে অবস্থান করছিল আরো তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা। নিবন্ধনকৃত ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহল। এর মধ্যে রোহিঙ্গাদের নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে নানা সামাজিক সংকট তৈরি হতে থাকে। এ অবস্থায় বাংলাদেশ হাতিয়ার কাছে মেঘনা মোহনার দ্বীপ ভাসান চরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা নেয় সরকার। নিজেদের অর্থায়নে ২৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে মোটামুটি ১৩ হাজার একর আয়তনের ভাসানচরে ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করে এক লাখের বেশি মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুই বছর আগেই রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে এ চরে স্থানান্তরের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও দেশর অভ্যন্তরে নানা কূটরাজনীতি এবং কিছু এনজিওর বিরোধিতার মুখে থমকে ছিল রোহিঙ্গা স্থানান্তর। জাতিসংঘসহ দেশি-বিদেশি এনজিওগুলোর বক্তব্য ছিল, কোনো শরণার্থীকে যেন জোরপূর্বক ভাসানচরে স্থানান্তরিত না করা হয়। এমনকি ভাসানচরের রোহিঙ্গারা যেন স্থানান্তরে আগ্রহ না দেখায় তার জন্য নানা অপপ্রচারও চালানো হয়। পরে কয়েক দফায় এনজিও ও রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা ভাসানচরের গুচ্ছগ্রামগুলো পরিদর্শন করেন। সরকারের সুপরিকল্পিত আয়োজনে সন্তোষ প্রকাশ করেন তারা। কিন্তু সাধারণ রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভাসানচর নিয়ে আগ্রহ তৈরি করা যাচ্ছিল না। সম্প্রতি মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসা তিন শতাধিক রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচরে নিয়ে রাখা হয়। এরপর গত ৫ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দলকে দেখার জন্য ভাসানচরে পাঠানো হয়। তারা ফেরার পর তাদের কথা শুনে রোহিঙ্গাদের একাংশ ভাসানচরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। এরপর ধীরে ধীরে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ভাসানচরে যাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়তে থাকে। বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারের তদবির ও আলাপ-আলোচনা শেষে রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের অনুকূল পরিবেশ তৈরি হওয়ার পর সম্প্রতি ২২টি এনজিও নোয়াখালীর হাতিয়ার এই দ্বীপে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় কাজও শুরু করে। গত বুধবার জাতিসংঘের বাংলাদেশ অফিস থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর প্রক্রিয়া যেন তাদের স্বেচ্ছাতেই হয়। জাতিসংঘ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে।’ বিবৃতিতে যেসব রোহিঙ্গা ভাসানচরে যেতে চায় তাদের মৌলিক অধিকার ও দ্বীপটিতে সেবাসমূহ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। অধিকারগুলোর মধ্যে মূল ভূ-খ-ে স্বাধীনভাবে যাওয়া-আসার অধিকারের পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও জীবিকার সুযোগ অন্তর্ভুক্ত।
জাতিসংঘ বলছে, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় তাদের যুক্ত করা হয়নি। রোহিঙ্গাদের সেখানে স্থানান্তরের সার্বিক কর্মকা- সম্পর্কে জাতিসংঘের কাছে পর্যাপ্ত তথ্যও নেই। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা যেন প্রাসঙ্গিক, নির্ভুল এবং হালনাগাদ তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সে বিষয়ে জোর দিয়েছে জাতিসংঘ। এর আগে ভাসানচর নিয়ে শুরু থেকেই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিরোধিতা থাকায় সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখতে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদলকে গত সেপ্টেম্বরে সেখানে পাঠানো হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল সরেজমিনে ভাসানচর ঘুরে এসে কক্সবাজারে থাকা রোহিঙ্গাদের সেখানকার পরিবেশ-পরিস্থিতি জানাবেন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে প্রতিনিধিদলের সদস্যরা গণমাধ্যমকে জানান, সাগরের বুকে জেগে ওঠা ভাসানচরের আশ্রয়শিবির ভালো লেগেছে তাদের। সেখানকার অবকাঠামো কক্সবাজারের চেয়ে যথেষ্ট ভালো। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে খাদ্যগুদাম, সাইক্লোন শেল্টার, মসজিদ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, খেলার মাঠ, বাজার, কবরস্থান ও মাছ চাষের পুকুর। রয়েছে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির বাগান। পাশাপাশি সাগরের তীরে কেওড়াবাগান ও টেকসই বেড়িবাঁধ আছে।
এদিকে কক্সবাজারের শিবির থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ভাসানচরে স্থানান্তর অবিলম্বে বন্ধ করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দুটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন। নিউইয়র্কভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) ও লন্ডনভিত্তিক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল গতকাল বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানায়। দুটি সংগঠনই তাদের ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশ করেছে। গত সোমবার কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের প্রথম দলকে ১০ দিনের মধ্যে ভাসানচরে নেওয়ার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন সরকারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছুদ্দৌজা। তিনি জানিয়েছিলেন, আমরা এরই মধ্যে ভাসানচর পরিদর্শন করে এসেছি। আগামী সাত থেকে ১০ দিনের মধ্যে রোহিঙ্গাদের একটি দল ভাসানচরে স্থানান্তরের যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে। গতকাল রোহিঙ্গাদের প্রথম বহর যখন ভাসানচরের উদ্দেশে রওনা দিল তখন শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় থেকে সর্বশেষ কোনো তথ্য জানা যায়নি। এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ভোরের পাতা থেকে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শাহ রেজওয়ান হায়াতের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আর অতিরিক্ত কমিশনার শাসছুদ্দৌজা মোবাইল ফোন ধরেননি।