শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪ ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   ফিল্ম সিটি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাম   সিলেটের সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া গ্রেপ্তার   অনন্য অসাধারণ শেখ হাসিনা আমাদের গর্ব   নরসিংদীতে ‘থার্টি ফার্স্ট’ উপলক্ষে চাঁদা না দেয়ায় ব্যবসায়ীকে কোপালো সন্ত্রাসীরা   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
গল্লামারী গণহত্যা
ব্রাশ ফায়ারে বিকট শব্দ হত, তাই জবাই করে হত্যা করা হতো গল্লামারীতে
আরিফ রহমান
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:৫৩ পিএম | অনলাইন সংস্করণ

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে গল্লামারী জায়গাটি ছিলো এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। খুলনা শহরের অদূরবর্তী এই জায়গাটি সে সময় ছিলো বেশ নির্জন। গল্লামারী নদীর ওপরে থাকা পাকা এখনকার সেতুটি তখন ছিলো কাঠের পোল। তখন ছিলো না খুলনা-সাতক্ষীরা রোড। বর্তমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলা প্রশাসনিক ভবনটি ছিলো তখন একতলা বেতার কেন্দ্র। এই ভবন থেকে বেতারের অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হত। এই বেতার ভবনটিও ৭১-এ ছিলো নির্যাতন ও গণহত্যার অন্যতম কেন্দ্র। একদিকে নির্জনতা অন্যদিকে পাশ দিয়ে নদী বয়ে যাওয়ায় মানুষ হত্যার জন্য সব থেকে উপযোগী স্থান হিসেবে বেছে নিয়েছিলো পাক বাহিনী ও রাজাকাররা। এখানেই গড়ে ওঠে দেশের অন্যতম বধ্যভূমি। নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে বেতার ভবনে আটকে রাখা হতো, করা হত নির্যাতন। নির্যাতনের জন্য ভবনের পিছনের একটি দোচালা ঘর ও সামনের চত্বরও ব্যবহার করা হত। মৃত্যু নিশ্চিত হলে লাশগুলো ফেলে দেওয়া হত পাশদিয়ে বয়ে যাওয়া নদী এবং সামনের নির্জন জায়গাটিতে।

১৯৭১ সালে খুলনা বেতার কেন্দ্রের এনাউন্সার ছিলেন হামিদুর রহমান। তিনি ছিলেন এখানকার গণহত্যার অন্যতম সাক্ষী। তার এখনো মনে আছে-বেতারকেন্দ্রে লোকজনকে বেঁধে এনে কিভাবে নির্যাতন করা হত আর ব্রাশ ফায়ার করে মেরে ফেলা হত। তিনি বলেন, ‘বেতার কেন্দ্রে চাকরি করতে হত মিলিটারি বেষ্টনীর ভেতরে। দূরদূরান্ত থেকে লোকজন এনে বেতার কেন্দ্রে পুলিশ ব্যারাকে রাখা হত। তারপর সন্ধ্যা হলে সেই নিরীহ লোকগুলোকে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করা হত। কিছুদিন পরে ফায়ার করার পরিবর্তে জবাই করা শুরু করে জল্লাদরা। সেই সময়ে বাঙালি কিছু রাজাকার পাকবাহিনীর কাছ থেকে বাঙালি হত্যা করার দায়িত্ব নেয়।’

সারাদিন ধরে শহর ও গ্রাম থেকে বাঙালিদের ধরে এনে হেলিপোর্ট ও ইউ.এফ.ডি ক্লাবে জমায়েত করতো হানাদার বাহিনী। তারপর মধ্যরাতে হতভাগ্য নিরীহ বাঙালিদের পেছনে হাত বেঁধে বেতার কেন্দ্রের সামনে দাঁড় করিয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে ব্রাশফায়ার করতো। হত্যার আগে যখন তাদের ট্রাকে ভরে নিয়ে আসা হত তখন তাদের আর্তনাদে ভারি হয়ে উঠতো আকাশ-বাতাস। রাস্তার আশেপাশের মানুষ সে আর্তনাদ শুনলেও কারফিউ’র কারণে তাদের বাইরে বেরুনোর উপায় ছিলো না। অনেকে আপনজনের লাশ শনাক্ত করলেও লাশ উঠিয়ে নিতে পারতেন না কারণ বর্বরেরা জানতে পারলে তাকেও হত্যা করবে। ব্রাশ ফায়ারে যে বিকট আওয়াজ হত তা আশপাশে ছড়িয়ে পড়তো। তাই এক সময় পাক বাহিনী গুলি করে হত্যার পরিবর্তে জবাই করে হত্যা শুরু করে। প্রতিরাতে শতাধিক মানুষকে এখানে জবাই করা হত! দিনদিন এ সংখ্যা বাড়তে শুরু করে। শুধু রাতের বেলা হত্যা করে সময় কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না হানাদার ও রাজাকাররা। এরপর দিনের বেলাতেও শুরু হয় হত্যাযজ্ঞ। সকলের চোখের সামনে দিয়ে পিঠমোড়া দিয়ে ট্রাকভর্তি বাঙালিদের গল্লামারী নিয়ে যাওয়া হত বধ্যভূমিতে। প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখতো ঘণ্টাখানেক পরে সেইসব ট্রাক ফিরে আসতো খালি। গল্লামারীতে পড়ে থাকতো তাদের নিথরদেহগুলো। বধ্যভূমিতে নিয়ে যাওয়ার আগে অনেকে নির্যাতনে মারা যেত। কাউকে কাউকে গুলি করে বা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে বা জবাই করে হত্যা করা হত বেতার কেন্দ্রের সামনের খালি জায়গায় এবং পেছনের দোচালা ঘরটিতে।

খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পরে গল্লামারী খাল থেকে দুই ট্রাক মাথার খুলি পাওয়া গিয়েছিলো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে অনেকেই ওই ঘরটিতে নির্যাতিতদের রক্তমাখা জামা-কাপড় ও ব্যবহার্য টুকিটাকি জিনিসপত্র যেমন দেখেছেন; তেমনি দেখেছেন দেয়ালে রক্ত দিয়ে নানা আকুতির কথা লেখা। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্যাতিত এমনি একজনের আকুতিভরা লেখা ছিলো এমনÑ ‘মা তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না’।

এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি দৈনিক বাংলায় লেখা হয়- ‘গল্লামারী খুলনা শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে মাত্র দেড়মাইল দূরে। সেখানে শুধু ধানের ক্ষেত। মার্চের আগে গল্লামারী নামটা শুনলে চোখের সামনে ভেসে উঠতো বাতাসে দোল খাওয়া আদিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেত। কিন্তু মার্চের পরে? তখন গল্লামারী নাম শুনলে খুলনার যে কোন লোকের মন আতঙ্কে ভরে উঠতো। হাজার হাজার বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিলো গল্লামারী। সম্ভবত, বাংলাদেশে গল্লামারীর মতো দ্বিতীয় কোনো স্থান নেই যেখানে জল্লাদরা এত অধিক সংখ্যক বাঙালিকে জবাই করে হত্যা করেছে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলি গণহত্যার চেয়েও বেশি মানুষকে এখানে জবাই করে হত্যা করা হয়। যদিও যুদ্ধের ৯ মাসে কত মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। 

স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সাত্তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর এখানে এসে লাশের পচা দুর্গন্ধ, কঙ্কাল, হাড়-গোড় এবং মাথার খুলিতে পা রাখা দায় ছিল। যা আজ কল্পনাকেও হার মানায়। যেখানে আজকের বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ, সেখানে ছিলো ধানক্ষেত। গল্লামারী নদী তীরবর্তী এলাকা, আশপাশের ধানক্ষেত, সামান্য দূরের বেতার সম্প্রচার ভবনসহ গোটা এলাকায় ছিলো হাজার হাজার মানুষের নিথর দেহ। অনেকে ছুটে গেছেন সেদিন স্বজনকে খুঁজতে। দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠা এলাকায় নাক-মুখ চেপে সেই অবশেষ লাশ, হাড়-গোড় ও কঙ্কালের মধ্যে প্রিয়জনের চিহ্ন খুঁজে বেড়াতেন স্বজনরা। কেউ পেয়েছে, কেউ পায়নি।’

গল্লামারী বধ্যভূমিতে কত জনকে হত্যা করা হয়েছিলো, তা যেমন নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি; তেমনি এখানে কাদের হত্যা করা হয়েছিলো, তার বেশির ভাগই শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। কেননা যুদ্ধকালে কেউ সেখানে যেতে সাহস করতেন না। যুদ্ধ শেষে যারা গেছেন, তারা দেখেছেন শুধু নরকঙ্কালের স্তূপ। বিভিন্ন প্রত্যক্ষদর্শীর মতে এখানে শহিদের সংখ্যা দশ হাজারের কাছাকাছি। এদের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা শান্তিলতা সাহা, দা কোপ থানার গড়খালী গ্রামের মাহাতাব বিশ্বাস অন্যতম। এই নারকীয় ঘটনায় অংশ নেয় স্থানীয় রাজাকার নওশের শেখ, জহুর শেখ, সোহরাব মোল্লা, হামিজুদ্দিন শেখ, সফিগাজী, আসমতো গাজী, আলাহি সানাওম নিসানা প্রমুখ।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গবেষক সুকুমার বিশ্বাস দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই গল্লামারীতে একাধিকবার গিয়েছেন। তিনি লিখেছেনÑ ‘১৯৭২ সালে এই গল্লামারী বধ্যভূমিতে আমি একাধিকবার গেছি। গিয়েছিলাম খুলনা বেতার কেন্দ্রেও। স্টুডিওগুলো ছিলো ধ্বংসপ্রায়। একটি স্টুডিও কক্ষে বাদ্যযন্ত্রগুলো ভেঙে চুরমার করে রাখা হয়েছিল। কেবল বেতার কেন্দ্র নয় খুলনার প্রায় সব এলাকা ঘুরেছিলাম। আমি ও আমার তিন সহকর্মী গিয়েছিলাম জাতীয় স্বাধীনতার ইতিহাস পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের তথ্য সংগ্রহ করতে। সেদিন গল্লামারীর বিস্তীর্ণ এলাকায় যে বীভৎস রূপ আমি দেখেছিলাম- তা অবর্ণনীয়। চারদিকে শুধু মাথার খুলি, হাড়গোড়, দেহাবশেষ দেখতে পেয়েছিলাম। মানবেতিহাসের এমন করুণতম দৃশ্যেও অভিজ্ঞতা বর্ণনা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আর যেন কোনো মানবসন্তানকে এটা দেখতে না হয়।’

গল্লামারী বধ্যভূমি নিয়ে আরও গবেষণা করেছেন খুলনার সরকারি ব্রজলাল কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অমল কুমার গাইন। খুলনা অঞ্চলের গণহত্যা নিয়ে লেখা তার আকরগ্রন্থ ‘গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণ কবর জরিপ :খুলনা জেলা’ এই গ্রন্থে গল্লামারী বধ্যভূমির কথা ওঠে এসেছে অনেক গুরুত্বের সাথে।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
https://www.dailyvorerpata.com/ad/BHousing_Investment_Press_6colX6in20200324140555 (1).jpg
https://www.dailyvorerpata.com/ad/last (2).gif
https://www.dailyvorerpata.com/ad/431205536-ezgif.com-optimize.gif
https://www.dailyvorerpata.com/ad/agrani.gif
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]