সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

শিরোনাম: স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   স্কুলে ভর্তির আবেদন শুরু আজ   ফিল্ম সিটি থেকে বাদ দেওয়া হচ্ছে ‘বঙ্গবন্ধুর’ নাম   সিলেটের সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া গ্রেপ্তার   অনন্য অসাধারণ শেখ হাসিনা আমাদের গর্ব   নরসিংদীতে ‘থার্টি ফার্স্ট’ উপলক্ষে চাঁদা না দেয়ায় ব্যবসায়ীকে কোপালো সন্ত্রাসীরা   
https://www.dailyvorerpata.com/ad/Inner Body.gif
১৯৭১-গণহত্যার গদ্য-১
‘সারাদিনেও পথেঘাটে পড়ে থাকা লাশ সাফ করতে পারিনি’
ঘটনাস্থল চুকনগর
আরিফ রহমান
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১:১৮ পিএম আপডেট: ০১.১২.২০২০ ১:৪৮ পিএম | প্রিন্ট সংস্করণ

আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি আমরা। আবার এসেছে ডিসেম্বর। ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। একাত্তরে আমাদের ৯ মাসের সংগ্রাম শেষে এই ডিসেম্বরেই আমরা পেয়েছিলাম বহুকাক্সিক্ষত বিজয়। আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসপাঠে সবসময় স্বাধীনতা আর বিজয় গুরুত্ব পেয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস নিয়ে চর্চা হয়েছে অনেক, কিন্তু এত সবের মাঝে কিছু বিষয় চাপা পড়ে গেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এই মাটিতে ত্রিশ লক্ষাধিক মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বাঙালি জাতির ওপর চালানো এই সিস্টেমেটিক নির্বিচার গণহত্যা বা জেনোসাইড হার মানিয়েছে হোলকাস্টকেও। জাতিসংঘ বলেছে, গত শতকে সর্বনিম্নতম সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে, ১৯৭১ সালে। ১৯৭১ যেমন স্বাধীনতার বছর, বিজয়ের বছর, ১৯৭১ তেমনি গণহত্যার বছর। আসছে ২০২১ সালে তাই আমাদের স্মরণে রাখতে হবে যে গণহত্যার অর্ধশতক পূর্ণ হলো। একাত্তরের গণহত্যায় নিহত শহীদদের উদ্দেশ্যেই এই সিরিজ নিবেদন করছি।

বাংলাদেশে সবচেয়ে কম সময়ে সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সম্ভবত ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ২০ মে সকালে চুকনগরে। মে মাসের শুরু থেকেই খুলনা-যশোর-সাতক্ষীরাসহ নিকটবর্তী অনেক জেলার হাজার হাজার পরিবার ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ভদ্রা নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত চুকনগরের রাস্তাটি ব্যবহার করতো। ১৯৭১ সালের ১৯ মে  সেরকম কয়েক হাজার মানুষ চুকনগরে খোলা মাঠে রাত কাটায়। উদ্দেশ্য ছিলো পরদিন সকালে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা। কিন্তু নিয়তির বিধান ছিল অন্যরকম। পরদিন ২০ মে ঘটেছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অল্প সময়ে অধিকসংখ্যক মানুষ হত্যার এক ভয়ঙ্করতম ঘটনা। এমন হত্যাযজ্ঞ পৃথিবীর ইতিহাসে কেটে গেছে এক নির্মমতম দাগ- যা কোনো ভাষা দিয়েই বর্ণনা করা যায় না। সেদিন বেলা সাড়ে দশটা থেকে শুরু হয়ে এই নারকীয় তা-ব চলে বিকাল অবধি। গুলি, ব্রাশফায়ার, বেয়নেটের আঘাতে ও নদীপথে পলায়নরত নর-নারী-শিশুর সলিল সমাধিতে কত মানুষের যে মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক হিসাব কেউ বলতে পারে না। তবে এই সংখ্যা কোনক্রমেই দশ হাজারের কম নয়, বরং বেশি বলে মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শী চুকনগর কলেজের অধ্যক্ষ এবিএম শফিকুল ইসলাম।

একাডেমিকভাবে বলতে গেলে চুকনগর গণহত্যা মূলত একটি ওয়েল প্ল্যানড সামরিক গণহত্যা যা ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। চুকনগর ভারতের নিকটবর্তী হওয়ায় স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিভিন্নস্থান থেকে লোকজন সীমান্ত অতিক্রমের জন্য এখানে এসে জড়ো হচ্ছিল। এদিন খুলনা ও বাগেরহাট থেকে ভদ্রানদী পাড়ি দিয়ে প্রায় ৩০-৪০ হাজার মানুষ চুকনগরে এসে জড়ো হয়। ২০ মে বেলা ১১টার সময় পাক সামরিক বাহিনীর দুটি দল একটি ট্রাক ও একটি জিপে করে এসে চুকনগর বাজারের উত্তরে কাউতলা নামক একটি স্থানে থামে। পাতখোলা বাজার থেকে তারা গুলি করতে করতে চুকনগর বাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। চুকনগরে মৃতদের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা না গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে মৃতের সংখ্যা ৮ থেকে ১০ হাজার। মৃতদেহগুলো হানাদার বাহিনী নদীতে নিক্ষেপ করে এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় লোকজন অবশিষ্ট দেহগুলোর অধিকাংশ নদীর পানিতে ফেলে দিতে বাধ্য হন।

চুকনগর কলেজের সামনে যে মাঠ তাকে বলা হয় পাতখোলা বিট। এখানেও অগণিত লোককে হত্যা করা হয়। পাকসৈন্যরা চুকনগর বাজারের সামনে গাড়ি রেখে দুইভাগে ভাগ হয়ে গ্রামের ভেতর ঢুকে যায়। একটি দল চুকনগরে জড়ো হওয়া শরণার্থীদের ওপর নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। সৈন্যরা ৩-৪ ঘণ্টা লাগাতার এ গণহত্যা চালায় বলে জানায় সেই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীরা। নারী, শিশু কাউকে রেহাই দেয়নি ওরা। পলায়নরত নিরীহ মানুষের উপর গর্জে ওঠে তাদের মেশিনগান। কেউ কেউ গুলিবিদ্ধ হয়ে ছুটে চলে, কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

সেনাবাহিনীর উপর তেড়ে যাওয়া চিকন আলী মোড়লকে হত্যার মধ্য দিয়ে এখানকার হত্যাযজ্ঞ শুরু হয় বলে জানা যায়। শহীদ চিকন আলীর ছেলে এরশাদ আলী মোড়ল আজও সে দিনের কথা মনে করে ক্ষোভে ফেটে পড়েন। আমি যখন ওই গণহত্যার তথ্য সংগ্রহে যাই তখন বর্বরোচিত সে গণহত্যার সাক্ষী হিসেবে পাই তাকে। সেদিনের কথা স্মরণে এলেই আর স্বাভাবিক থাকতে পারেন না এরশাদ আলী। আবেগে ভারাক্রান্ত আর জ¦লজ¦ল ফেটে পড়া চোখে তিনি বলেন, ‘ওরা মানুষ না, মানুষ কখনো মানুষকে এভাবে মারতে পারে না। প্রাণের মায়ায় যারা পালিয়ে যাচ্ছিল, তাদেরকে ওরা পাখির মত গুলি করে মারলো। গাছে উঠে, পানিতে নেমে কোনভাবেই তারা বাঁচতে পারলো না।’  হত্যাযজ্ঞের পর মাটিতে পড়ে থাকা হাজার হাজার লাশ সরিয়েছিলো ওই এলাকারই কাওছার আলী, দলিল উদ্দিন, আনসার সরদার ও ইনছান সরদার। কাওছার আলীর কাছে সেই দিন এখনো জ¦লজ¦লে। তার অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির কথা বলতে গিয়ে এখনো শিউরে ওঠেন তিনি। সেই দিনকে জীবনের জানা-শোনা কোনো অভিজ্ঞতার সঙ্গেই মেলাতে পারেন না তিনি। এত লাশ তাকে সরাতে হয়েছিল যে ঠিক সংখ্যাগণনার মতো কোনো পরিস্থিতির মুখে পড়লেই তার চোখে কেবল মানুষের লাশের ছবিই ভেসে ওঠে। বলছিলেন, ‘সারাদিনেও পথেঘাটে পড়ে থাকা লাশ সাফ করতে পারিনি। রক্তে ভদ্রা নদীর পানি একেবারে টকটকে লাল হয়ে গিয়েছিলো। লাশের সংখ্যা দশ-বারো হাজারের কম হবে না।’

তিনি আরও জানান, তাদের একজন ৪২০০ লাশ গুণে ছিলো। আর গুণতে পারেনি। লাশের গন্ধে নদীর পানি দুর্গন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া পাতখোলা বিট, বেহারাপাড়া, তাঁতীপাড়া, রায়পাড়া, জেলেপাড়া, বাজার, মন্দির, বটতলা, নদীরতীর, ঝোপঝাড়ের আড়াল সব জায়গায় ছিল শুধু লাশ আর লাশ। চুকনগর কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় এখানে মানুষের মাথার খুলি, হাড় পাওয়া যায়। চুকনগর গণহত্যায় হতাহত যারা তাদের প্রায় সবাই ছিলো বহিরাগত, একারণে অধিকাংশের নাম জানা সম্ভব হয়নি। এই বিষয়টি আমাদের স্মরণে রাখা উচিত যে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিভিন্ন পয়েন্টে জড়ো হওয়া শরণার্থীদের টার্গেট করে হত্যা করতো। ফলে এই শহীদদের নামীয় তালিকা প্রণয়ন কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ যেই পরিবারটি বাগেরহাট থেকে ভারতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে চুকনগরে এসে শহীদ হন তার গ্রামের অন্য পরিবারগুলো মনে করছেন সেই পরিবার ভারতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। অথচ তারা হয়তো পাকহানাদারদের গুলিতে পথেই হারিয়েছেন প্রাণ। হয়েছেন শহীদ। এরকম বাস্তবতায় গণহত্যায় মারা যাওয়া মানুষের পরিসংখ্যান পাওয়া দুরুহ কাজ। ফলে গণহত্যার ব্যাপকতাকে বুঝতে গেলে বিভিন্ন বিষয়, বিশেষ করে এ ধরনের বাস্তবতা হিসাবে রাখা জরুরি। চুকনগরে জরিপ করতে গিয়ে ভালো অভিজ্ঞতার মধ্যে একটাই হয়েছে যে চুকনগরের তরুণ প্রজন্মের যতো জনের সাথেই কথা বলার সুযোগ হয়েছে দেখেছি তারা এই গণহত্যায় শহীদের সংখ্যা নিয়ে কোনোধরনের সন্দেহ প্রকাশ করে না। তাদের দেখে আমার মনে হয়েছে যে আঞ্চলিক ইতিহাস যদি আঞ্চলিকভাবে সংরক্ষণের একটা প্রয়াস আমাদের থাকতো তাহলে স্বাধীনতাবিরোধীরা শহীদের সংখ্যা নিয়ে এতো বিভ্রান্তি ছড়াতে পারতো না।



« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
https://www.dailyvorerpata.com/ad/BHousing_Investment_Press_6colX6in20200324140555 (1).jpg
https://www.dailyvorerpata.com/ad/last (2).gif
https://www.dailyvorerpata.com/ad/431205536-ezgif.com-optimize.gif
https://www.dailyvorerpata.com/ad/agrani.gif
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ


সম্পাদক ও প্রকাশক: ড. কাজী এরতেজা হাসান
সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
সাউথ ওয়েস্টার্ন মিডিয়া গ্রুপ


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম


©ডেইলি ভোরের পাতা ডটকম

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : ৯৩ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ, কারওয়ান বাজার, ঢাকা-১২১৫।
ফোন:৮৮-০২-৪১০১০০৮৭, ৪১০১০০৮৬, বিজ্ঞাপন বিভাগ: ৪১০১০০৮৪, ফ্যাক্স : ৮৮-০২-৪১০১০০৮৫
অনলাইন ইমেইল: [email protected] বার্তা ইমেইল:[email protected] বিজ্ঞাপন ইমেইল:[email protected]