#শিক্ষিত সমাজরা এই মৌলবাদীদের নিয়ে তেমন প্রতিবাদ করছেন না: ড. ওয়ালি-উর রহমান।
#বাংলাদেশে মৌলবাদের বীজ স্বাধীনতার আগেই বপন করা হয়েছে: ড. মো. আফজাল হোসেন।
#আজ সারা পৃথিবীর কাছে বঙ্গবন্ধু হচ্ছে উন্নয়নের ট্রেডমার্ক: উইলিয়াম প্রলয় সমদ্দার।
সম্প্রতি একটি ইসলামি রাজনৈতিক দল ও তাদের অনুসারীদের বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ভাস্কর্য বিরোধী নতুন আন্দোলন শুরু হয়েছে। যদিও আল কোরআন এবং এর ব্যাখ্যা সম্বলিত তাফসির গ্রন্থে ইসলাম ধর্ম ভাস্কর্য নির্মাণ বা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেছে, এমন কোনও বক্তব্য নেই। প্রতিটি মুসলমানের কথায়-কাজে মুগ্ধ হয়ে যেন বিশ্বের মানুষ বুঝতে পারে, ইসলামের সঙ্গে সন্ত্রাসের কোনও সম্পর্ক নেই। কিন্তু তাদের যেটা করা উচিত, সেটা না করে, করছে উল্টোটা। বাঙ্গালির সংস্কৃতিরই শক্তি আছে বাঙালির মুক্তি ও গৌরবের সৌধ ও ভাস্কর্য রক্ষার। সুতরাং বিজয় মাসের লগ্নে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু হোক।
দৈনিক ভোরের পাতার নিয়মিত আয়োজন ভোরের পাতা সংলাপের ১৭৪ তম পর্বে এসব কথা বলেন আলোচকরা। সোমবার (৩০ নভেম্বর) আলোচক হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক পররাষ্ট্র সচিব এবং বাংলাদেশ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ড. ওয়ালি-উর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আফজাল হোসেন, খ্রিষ্টান এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক উইলিয়াম প্রলয় সমদ্দার। দৈনিক ভোরের পাতার সম্পাদক ও প্রকাশক ড. কাজী এরতেজা হাসানের পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনা করেন সাবেক তথ্য সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ।
ড. ওয়ালি-উর রহমান বলেন, এটা আমার ধারণা যে, আমাদের যারা শিক্ষিত সমাজ আছেন; তাদের কাছ থেকে কোন প্রতিষ্ঠিত প্রতিবাদ পাচ্ছি না এখন পর্যন্ত। আমি অবাক হয়েছি তাদের সাথে কথা বলে। কথা বলার সময় তাদের মধ্যে একটা অনীহা ভাব লক্ষ্য করেছি। আমাদের ভুললে চলবে না যে, আফগানিস্তানে যখন তালেবান যোদ্ধারা যুদ্ধ শুরু করেছিল তাদের প্রধান টার্গেট ছিল পৃথিবীর মধ্যে সবচে পুরনো ভাস্কর্য অর্থাৎ বামিয়ানের ভুবনবিখ্যাত বুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙ্গে ফেলা এবং এটা তারা করেছেও কিন্তু। এটা একটা দুষ্ট চিন্তা, দুষ্ট বুদ্ধির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তারা এইভাবে মানুষের মনকে দেখাতে চাঁচ্ছে আমরা ভয়ঙ্কর কিছু একটা হবো। পৃথিবীর যারা সাধারণ মুসলমান আছে তাদের কাছে এই গোত্রের লোকেরা প্রমাণ করতে চেয়েছে এটা আনইসলামিক। পবিত্র কোরআন শরীফে বলা আছে ইসলামটা কি। দিনে দুপুরে আমরা এই পবিত্র কোরআন শরীফ পরছি, এটা মানছি। এটাই প্রকৃত ইসলাম। বাংলাদেশের অল্প কিছু মুসলমানের ইসলাম সম্পর্কে ধর্মীয় অনুভূতি যেন অতি স্পর্শকাতর। কথায় কথায় তাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। ইসলাম সবসময়ই ভিন্ন ধর্মকে, ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করে। এ অঞ্চলের বরাবরই সব ধর্মের মানুষ নির্বিঘ্নে নিজ নিজ ধর্ম পালন করে আসছে। হিন্দুরা মুসলমানদের ঈদ উৎসবে যোগ দেয়, মুসলমানরা হিন্দুদের পূজা উৎসবে যোগ দেয়। তার মানে কিন্তু কোনও হিন্দু নামাজ পড়ে না, কোনও মুসলমানও পূজা করে না। শুধু উৎসবটা সবাই মিলে মিশে করে। পৃথিবীর বহু জাগাতে ইসলাম আইনে প্রতিষ্ঠিত সেসব দেশেও কিন্তু অনেক ভাস্কর্য রয়েছে। সেখানে তো কেউ কিছু বলছে না, কেন বাংলাদেশে এটা নিয়ে এতো কথা হচ্ছে? আইয়ুব খানের দুইটি বই আছে, সেখানে তিনি আমাদের বাঙালি মুসলমানদের নিয়ে অনেক কুটু কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা প্রকৃত মুসলমান নয়। কয়েকদিন আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসায় আল্লামা শফী গ্রুপের বিপক্ষে বাবুনগরী গ্রুপ বিদ্রোহ করে। তারা অসুস্থ আল্লামা শফীকে জিম্মি করে দাবি আদায় করে। হাটহাজারী মাদ্রাসা নিয়ে শফী এবং বাবুনগরী গ্রুপ একে অপরকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করে। আজকে এই যে বাবুনগরী আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একটা দুষ্ট, বদমাশ, অসভ্য লোক তিনি। সেদিন শাপলা চত্বরে তাদের অপকর্মের কথা আজো ভুলিনি। সে নিজেও একজন আসল মুসলিম নয়। তাকে ধিক্কার জানাই আমি। তাকে সে সময় রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল তার অপকর্মের জন্য এবং সে কান ধরে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে যেটা করেছিল সেটা অন্যায় ছিল, অনৈসলামিক ছিল। এরা ইসলাম সম্পর্কে জানে না, জানতে চায়ও না; কেউ জানতে চাইলেও তাদের প্রবল আপত্তি।
ড. মো. আফজাল হোসেন বলেন, শুরুতেই আমি স্মরণ করবো যে মানুষটি আমাদের একটি স্বাধীন বাংলা উপহার দিয়ে গিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখে আমি আমার বক্তব্য শুরু করতে চাচ্ছি। বাংলাদেশে মৌলবাদীদের বীজ স্বাধীনতার আগে থেকেই ছিল। পাকিস্তান সরকার ১৯৪৭ সালে যখন এই দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করলো তখন থেকেই এই দেশে মৌলবাদীদের বীজ বপন হয়েছিল। এবং সেই বীজগুলো ফুলে ফলে ভরে সুশোভিত হয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান এবং সেই পাকিস্তানের দোসর এবং আমাদের কিছু বিপথগামী সেনা জোয়ানদের মাধ্যমে আমাদের যে স্বাধীনতার যে অর্জন, আমাদের চেতনাবোধ থামিয়ে দিয়েছিল। মূর্তি বা ভাস্কর্য মাত্রই শিরকের উপকরণ-এমন কোন কথা নেই বরং যেটি যে উদ্দেশ্যে বানানো হয় সেটিকে সেভাবে বিবেচনা করতে হবে। বাংলাদেশে মৌলবাদ মাথাচাড়া দেওয়ার পেছনে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক এবং দেশীয় রাজনীতির প্রভাবকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আমাদের প্রথম সংবিধান ৪টি মূল নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এই ৪টি মূল নীতির একটি ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা। এই ধর্ম নিরপেক্ষতা শব্দটিকে ১৯৭৫ সালের পরে জিয়াউর রহমান এটাকে নানানভাবে অপব্যাখ্যা দিয়ে প্রচার করেছিল যে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে ধর্ম হীনতা। তার মানে ধর্ম হীনতার নামে অপব্যাখ্যা সৃষ্টি করে তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরে আওয়ামী লীগের ইমেজ নষ্ট করার চেষ্টা করেছিল। গোঁড়া তালেবানি ভাবধারায় ভাস্কর্য নির্মাণ নিষিদ্ধ হেফাজতীরা সম্পূর্ণভাবে অ-ইসলামী সেই ভাবধারা প্রবর্তনের কথা বলছে। হেফাজতীরা যদি সত্যিই ভাস্কর্য নির্মাণের বিরোধী হয়ে থাকেন তবে এর প্রমাণ তারা তাদের হাটহাজারীর কাছেই অবস্থিত খাগড়াছড়িতে প্রদর্শন করতে পারেন। খাগড়াছড়ি শহরের দ্বারপ্রান্তে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের একটি বৃহাদাকার ভাস্কর্য নির্মিত হয়েছে। মানুষের এই মূর্তিটি তারা ভাঙতে পারেন, কিন্তু না তারা এটা না করে আমাদের জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার পায়তারা করছে। যারা বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে জড়িত ছিল তারা অনেকেই সাক্ষী দিয়েছেন যে এই হত্যার সাথে জিয়াউর রহমান জড়িত ছিলেন। আমাদের দেশে এই যে শোলাকিয়া ঈদগা মাঠে বোমা হামালা, হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়েছে, গোপালগঞ্জে আমাদের নেত্রীর ব্যক্তিতার মঞ্চের নিচে বোমা পুতে রাখা হয়েছে; এসমস্ত সকল কর্মকাণ্ড গুলো বিএনপির আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে মৌলবাদীদের ব্যবহার করে করা হয়েছে।
উইলিয়াম প্রলয় সমদ্দার বলেন, আজকের আমার বক্তব্যের শুরুতেই বলতে চাচ্ছি, আজকের এই যে আন্দোলন এটার লক্ষ কি? ভাস্কর্য নাকি বঙ্গবন্ধু? ১৯৭২ সালের পরে স্বাধীনতার বিরোধী গোষ্ঠীর টার্গেট কি ছিল? স্বাধীন বাংলাদেশ নাকি বঙ্গবন্ধু? ১৯৭৫ সালের পরে নানা কায়দায় নানা প্রক্রিয়াই বঙ্গবন্ধুর নাম ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তারা তাতে সক্ষম হয়নি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় ফিরে আসার পর ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের গণহত্যায় সাহায্যদানকারী জামায়াত নেতাদের ফাঁসি দেন এবং তাদের সন্ত্রাস দমন করেন। মনে হয়েছিল বাংলাদেশ ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের কবলমুক্ত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের এই আশা সত্য প্রমাণিত হয়নি। দেশে জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসের রাজনীতির সময় হেফাজত ছিল একটি মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামি শিক্ষা আন্দোলন। রাজনীতির সঙ্গে তার কোনো যোগ ছিল না বলা হতো। জামায়াত দেশের মানুষের কাছে ঘৃণ্য ও প্রত্যাখ্যাত রাজনৈতিক দল হওয়ার পর তাদের একদল হেফাজতে ঢুকে পড়ে এবং হেফাজতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের চেষ্টা চালাচ্ছে এখন। আজ সারা পৃথিবীর কাছে বঙ্গবন্ধু হচ্ছে উন্নয়নের ট্রেডমার্ক। সুতরাং আজকের যে আন্দোলন হচ্ছে এটাতে ভাস্কর্য শুধু একটা ফ্যাক্ট মাত্র। এর মূল টার্গেট হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু মানুষের হৃদয়ে যেভাবে গেঁথে গেছে এর ধারাকে কমিয়ে আনা যায় কিনা! এখন সময় রুখে দাঁড়ানোর। এই বাংলাদেশে মৌলবাদীদের আর এক ইঞ্চিও ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।