রাজশাহী মহানগরীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে স্থাপিত সিগন্যাল বাতিগুলো নষ্ট হয়ে আছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত এসব সিগন্যাল বাতি সারাইয়ের ব্যবস্থা তো হচ্ছেই না, নতুন সিগন্যাল বাতি স্থাপনেরও কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। ফলে নগরীর যানজট নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। একসময় রাজশাহী নগরীতে গণপরিবহণ বলতে প্যাডেল চালিত রিকশা, টেম্পু ও ঘোড়ার গাড়ি ছিল। নগরীর মধ্যে মূলত রিকশা ও ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহার করে মানুষ বিভিন্নস্থানে যাতায়াত করতো।
২০০৮ সালের পর রাজশাহী নগরীতে চলাচলের মাধ্যম হিসাবে যোগ হয় অটোরিকশা। ২০০৮ সালের আগে টেম্পু রিকশা মিলে এক হাজারের মত যানবাহন নগরীর মধ্যে চলাচল করতো। কিন্তু অটোরিকশা আসার পর এ সংখ্যা যেমন বাড়তে থাকে তেমনি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে যানজটও। গুটিকয়েক যানবাহন চলার কারণে আগে রাজশাহী নগরীতে ছিল না কোনো যানজট। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে রাজশাহীতে বেড়েছে মানুষ, বেড়েছে যানবাহন। এক সময়কার যানজট মুক্ত রাজশাহী নগরী এখন যানজটের নগরীতে পরিণত হয়েছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষ বাড়ার কারণে যানবাহনের পরিধি বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে যানজটমুক্ত রাজশাহী নগরী এখন প্রতিনিয়িত যানজটের নগরে পরিণত হয়েছে। যানজট নিয়ন্ত্রণে স্থাপিত সিগন্যাল বাতিগুলো অকার্যকর থাকায় যানজটের পরিস্থিতি দিনদিন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিগন্যাল বাতি মেরামতে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) এখনো পর্যন্ত কোনো পরিকল্পনা নেই। এমনকি বর্তমানে এসব সিগন্যাল বাতি কি অবস্থায় আছে তাও বলতে পারছেন না রাসিকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ। নগরীতে স্থাপন করা প্রায় দেড় কোটি টাকার সিগন্যাল বাতি অযতœ অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে। রাসিকের তদারকির অভাবে এসব সিগন্যাল বাতি কোনোই কাজে লাগছে না ট্রাফিক বিভাগের।
জানা গেছে, পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজশাহী নগরীতে যানজট বাড়তে পারে এই কারণে রাসিক থেকে নেওয়া হয় উদ্যোগ। যানচলাচলের গতি নিয়ন্ত্রণে রাসিকের উদ্যোগে ১৯৯৪ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ৩ দফায় নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় ও ২০টির বেশি স্থানে স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি স্থাপন করা হয়। সিগন্যাল বাতি স্থাপনের পর সেগুলো সচল রাখার জন্য রাসিকের যান্ত্রিক বিভাগকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। প্রথম সিগন্যাল বাতি স্থাপনের পেরিয়ে গেছে ২৪ বছর। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এসব সিগন্যাল বাতি সচল থাকলেও এরপর থেকে একে একে নষ্ট হয়ে গেছে সবগুলো। বলা যায় প্রায় এক যুগ ধরে এসব সিগন্যাল বাতি অকেজো হয়ে পড়ে আছে।
রাসিক সূত্র জানায়, প্রথম দফায় ১৯৯৪ সালে ৩৬ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর সিঅ্যান্ডবি, লক্ষ্মীপুর, বিন্দুর মোড়, সাহেববাজার জিরোপয়েন্ট, মনিচত্বর ও তালাইমারী মোড়ে ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি (সংকেত বাতি) বসানো হয়। এরপর ২০০২ সালে ৪৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ বন্ধগেট, বহরমপুর বাইপাস রোড, কোর্ট স্টেশন মোড়, কাশিয়াডাঙ্গা নতুন বাইপাস মোড় ও কাশিয়াডাঙ্গা পুরনো সড়ক মোড় এলাকায় বসানো হয় ট্রাফিক সিগন্যাল বাতি বসানো হয়। এরপর ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে নগরীর উৎসব সিনেমা হল মোড়, সাগরপাড়া বটতলা, শিরোইল স্টেশন মোড়, শহীদ জিয়া শিশুপার্কের সামনের মোড় ও নওদাপাড়া আমচত্বর মোড় এলাকায় ট্রাফিক সিগন্যাল স্থাপন হয়। কিন্তু এখন এসব সিগন্যালবাতির সবই অকেজো হয়ে পড়ে আছে। কিছু কিছু এলাকায় সিগন্যাল বাতি থাকলেও দেখা যায় না। দোকানঘর নির্মাণ করে পুরো সিগন্যাল বাতি ঢেকে দেয়া হয়েছে। সিগন্যাল বাতিগুলো অযতেœ অবহেলায় ময়লার স্তুপ পড়ে আছে।
নগরীর বর্নালী মোড়ের ডিউটিরত এক ট্রাফিক পুলিশ জানান, দিনদিন শহরে মানুষ বাড়ছে। বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে এখন সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। যানজট নিরসনে রাখা হয়েছে ট্রাফিক পুলিশ। কিন্তু যানযট নিয়ন্ত্রণের পক্ষে নিয়োগকৃত ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা অপ্রতুল। সিগন্যাল বাতিগুলো কার্যকর থাকলে এ চাপ অনেক কমে যেতো। তিনি বলেন, দেশ আধুনিক হয়েছে, কিন্তু রাজশাহীর ট্রাফিক বিভাগ সেই আগের অবস্থাতেই রয়ে গেছে। রাজশাহী শহরে যানজট নিরসনের প্রক্রিয়ায় লাগেনি আধুনিকতার ছোঁয়া। নগরীতে যানজট এখন নিত্যদিনের সঙ্গি হলেও তাদের সেই পুরোনা যুগের মতই হাতের ইশায় যানজট নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে। নগরীর বিন্দুর মোড় এলাকার দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশরা জানান, এখনো চাররাস্তার মোড়ে প্রতিদিন যানজট নিয়ন্ত্রনে হিমশিম খেতে হয়। এই জনগুরুত্বপূর্ন জায়গার সিগন্যাল বাতিটি দীর্ঘদিন থেকে নষ্ট হয়ে আছে। দেখা-শোনার মানুষ নেই বললেই চলে।
এদিকে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে নগরীতে সয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগনালা স্থাপনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়, নগরীর ২৬টি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে (মোড়ে) আধুনিক ট্রাফিক সিগনাল বাতি স্থাপন করা হবে। পরিকল্পনাটি ভারতীয় ঋণ ও সরকারের জিওবি তহবিলের আওতায় বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের ডিপিপি বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগে অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন আছে। অনুমোদন পেলে ২০২০-২১ অর্থবছরের মধ্যেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা হবে। বিষয়টি এখন পর্যন্ত অনুমোদনের অপেক্ষা ঝুলে আছে।
নগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস জানান, নগরীর সিগন্যাল বাতিগুলো মূলত রাসিকের অধিনে পরিচালিত হয়। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি) পক্ষে এসব দেখা হয় না। তিনি বলেন সিগন্যাল বাতি না থাকার কারণে ভোগান্তি পোহাতে হয় ট্রাফিক পুলিশদের। কারণ সিগন্যাল বাতি থাকলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি আসতো। কিন্তু ধীর্ঘদিন থেকে এসব সিগন্যাল বাতি অকেজো হয়ে পড়ে থাকার জন্য কোনোই কাজে আসছে না।
এ ব্যাপারে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল বাসার বলেন, ‘বর্তমানে সিগন্যাল বাতিগুলো কি অবস্থায় আছে আমি তা জানি না। মূলত সিগন্যাল বাতিগুলো রাকিসের যান্ত্রিক প্রকৌশল বিভাগের দায়িত্বে আছে। নগরীতে কতটি সিগন্যাল বাতি সচল রয়েছে আর কতটি অচল রয়েছে তারাই ভালো বলতে পারেবন।’ অকেজো সিগন্যাল বাতি সচল করার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা সে ব্যপারেও স্পষ্ট কিছু বলতে পারেননি এ কর্মকর্তা।