সাধারণ মানুষকে ঋণ দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে ব্যাংকগুলো। কোনও কোনও ব্যাংক এরই মধ্যে ঋণ বিতরণের পদ্ধতিও ভুলে যাচ্ছে! ঋণ বিতরণে ব্যাংকের এতটাই অনীহা যে, তারা সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণেও গড়িমসি করছে। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মাঝেও প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। এমন অভিযোগ করেছেন অনেক ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। এদিকে, ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ যে কমিয়ে দিয়েছে, তার প্রমাণ মেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবরে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহ প্রায় এক শতাংশ কমে গেছে। অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তারা সেটাকে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি বলছেন। এ প্রসঙ্গে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার ব্যবসায়ী মা মনি এন্টারপ্রাইজের মালিক আবদুস সালাম বলেন, ‘আমরা ব্যাংক থেকে ঋণ পাই না। ব্যাংকে গেলে বলা হয়, ঋণ দেওয়া বন্ধ।’ তিনি বলেন, ‘সাধারণ ও ছোট উদ্যোক্তাদেরকে ব্যাংকগুলো আগেও পাত্তা দেয়নি, এখন তো বলে ঋণ দেওয়ার মতো নাকি টাকা নেই।’
নাম প্রকাশ না করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এ প্রসঙ্গে বলেন, টাকা ফেরত আসবে এমন গ্রাহককেই বাছাই করেই আমরা ঋণ দেই। কিন্তু যে গ্রাহক টাকা ফেরত দেবে না, তাকে কে ঋণ দেবে? এখন তো ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলেও খেলাপি বলা যাচ্ছে না। ফলে ঋণের টাকা ফেরত আসার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে। আগের নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত আসছে না। ফলে নতুন করে ঋণ দেওয়ার মতো ঝুঁকি অনেক ব্যাংকই আর নিতে চাইছে না। এ কারণে নতুন করে নতুন গ্রাহককে ঋণ দেওয়া ছেড়ে দিয়েছে অনেক ব্যাংক। অবশ্য প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ঋণ বিতরণ করার ফলে করোনাভাইরাস মহামারির মাঝে অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর সঙ্গে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহেও গতি ফিরছিল। কিন্তু তিন মাস ধরে বেসরকারি ঋণের পালে যে হাওয়া বইছিল, হঠাৎ তার ছন্দপতন হয়েছে। ফের বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি সর্বনিম্নে এসে ঠেকেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবরের তুলনায় ব্যাংকগুলোর এই অক্টোবরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। যদিও এক মাস আগে অর্থাৎ গত বছরের সেপ্টেম্বরের চেয়ে এই বছরের সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি ঋণ বিতরণ করেছিল ব্যাংকগুলো। আর আগস্টে এ খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাইয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ২০ শতাংশ। জুনে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের চতুর্থ মাস অক্টোবর শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩২ কোটি ২৪ লাখ টাকা, যা গত বছরের অক্টোরের চেয়ে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। সেপ্টেম্বরের শেষে বেসরকারি খাতে বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১১ লাখ ১৩ হাজার ৮২ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত এক মাসে এক হাজার কোটি টাকাও বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। অবশ্য গত এক বছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক। অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ১৪ হাজার ৩২২ কোটি ৪০ লাখ টাকা, ২০১৯ সালের অক্টোবরের শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ২৫ হাজার ৯৫৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা।
শুধু বেসরকারি খাতেই নয়, সরকারি খাতেও ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমেছে। অক্টোবর মাসের শেষে সরকারিখাতে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৯১ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা, যা গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে ২৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ বেশি। গত সেপ্টেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ মাস জুনে সরকারি খাতে ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। পরিসংখ্যান বলছে, গত ১০ বছর ধরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দুই অংক বা ১০ শতাংশের ওপরে ছিল। তবে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরের পর গত বছরের নভেম্বর মাসে প্রথমবারের মতো তা ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে আসে। ধারাবাহিকভাবে এই প্রবৃদ্ধি কমতে কমতে গত এপ্রিলে ৯ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ওই মাসে বেসরকারি ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে যায়। গত জুনে তা আরও কমে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে নেমে আসে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘ছোটদের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিলের ঋণ খুব একটা বিতরণ করেনি ব্যাংকগুলো। অন্য প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণও খুব একটা বিতরণ হয়নি। এছাড়া গত কয়েক মাসে প্রণোদনার বাইরে অন্য কোনও ঋণ বিতরণ হয়নি। তবে করোনাকালে সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, সেগুলোর বাস্তবায়নে গতি আসায় গত কয়েক মাস বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বেড়েছিল।’ তবে নিরাপদে মুনাফা পেতে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মহামারির কারণে অর্থনীতি নিম্নগামী হলেও বেড়েই চলেছে বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ। যদিও করোনা পরিস্থিতিতে বিল ও বন্ডের সুদহার দুই থেকে এক-চতুর্থাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। তারপরেও কমছে না বিনিয়োগ। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনার মধ্যে অন্যান্য খাতের ঋণের তুলনায় বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোর আগ্রহ তুলনামূলকভাবে বেশি। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করে কেউই ঝুঁকি বাড়াতে চায় না।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক খাতে আগস্টের শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল এক লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা। গত দুই মাসে এ অলস অর্থের পরিমাণ আরও বেড়েছে। এ প্রসঙ্গে বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়া অন্য কোনও খাতে ঋণ বিতরণ হচ্ছে না। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের ঋণ বিতরণে কোনও অগ্রগতি নেই। তাই বেশিরভাগ ব্যাংকই এখন বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত বন্ড ও বিলে তিন লাখ দুই হাজার ৭৮ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক। এর মধ্যে দুই লাখ ৪২ হাজার ২১৮ কোটি টাকার বন্ড ও ৫৯ হাজার ৮৬০ কোটি টাকার বিল বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, এক বছরের ব্যবধানে বিল ও বন্ডে ৮০ হাজার ২৩৮ কোটি ৩২ লাখ টাকার বিনিয়োগ বেড়েছে ব্যাংকের। বিল ও বন্ডে ২০২০ সালের জুন শেষে দুই লাখ ৭৯ হাজার ৬০১ কোটি ৯৭ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছে ব্যাংক। আগের বছরের একই সময়ে এই বিনিয়োগ ছিল এক লাখ ৯৯ হাজার ৩৬৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। জানা গেছে, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে দেশের ব্যাংক খাত থেকে স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেয় সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, করোনা পরিস্থিতিতে সরকারি এসব বিলের সুদহার নামিয়ে এনেছে এক-চতুর্থাংশে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ৯১ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদহার ছিল সাত দশমিক ১২ শতাংশ। অক্টোবরে তা নেমেছে ১ দশমিক ৫৪ শতাংশে। ট্রেজারি বিলের মতোই সুদহার কমেছে বন্ডেরও। জানুয়ারিতে দুই বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের গড় সুদহার ছিল ৮ দশমিক ২২ শতাংশ। অথচ অক্টোবরে তা ৩ দশমিক ৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে। একইভাবে বন্ড বা সুদহার কমেছে ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডেরও।